আমরা প্রায় সকলেই জানি ভিটামিন ‘এ’ কি, কত প্রকার ও আমাদের শরীরের জন্যে কেন ভিটামিন ‘এ’ এর প্রয়োজন। আজ আমরা জানবো যেসব লক্ষণ দেখে বোঝা যাবে যে আমাদের শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব দেখা দিয়েছে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেসব খাদ্য গ্রহণ করে থাকি, সেসব খাদ্যে সাধারণত দুই ধরণের ভিটামিন ‘এ’ থাকে। একটা রেটিনাল বা পারফর্মড্ ভিটামিন ‘এ’ যা সাধারণত মাছ, মাংশ, ডিম ও দুধ জাতীয় খাবারে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, উদ্ভিদ জাতীয় খাবার যেমন লাল, সবুজ, হলুদ ও কমলা জাতীয় শাক-সবজি ও ফলমূলে পাওয়া যায় দ্বিতীয় প্রকারের ভিটামিন ‘এ’ যাকে ক্যারোটিনয়েডস্ বলা হয়ে থাকে।
উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত এ দুই ধরণের ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব দেখা না দিলেও অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশে মারাত্মকভাবে এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলার এবং নতুন মা যাদের সন্তানকে নিয়মিত দুধ পান করাতে হয়, তারা সাধারণত ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে ভুগে থাকেন। আবার ছোট বাচ্চা ও শিশুরাও এই বিশেষ ভিটামিনটির অভাবে ভুগে থাকে।
কিভাবে বুঝবেন আপনিও ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে ভুগছেন কিনা? জেনে নিন ৮টি লক্ষণ যা আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে-
যেসব লক্ষণে বুঝবেন ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে ভুগছেন
যদি ত্বকের শুষ্কতা দেখা দেয়
ত্বকের জন্যে প্রয়োজনীয় সেলের সৃষ্টি ও রিপেয়ারের জন্যে ভিটামিন ‘এ’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ত্বকের যে কোন ধরণের প্রদাহকে রুখে দিতেও সাহায্য করে থাকে।
যথেষ্ট্য পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ না হলে ত্বকে একজিমাসহ নানা রকম অ্যালার্জি জাতীয় রোগের উৎপত্তি হয়। অ্যাকজিমা এমন একটি রোগ যা ত্বককে শুষ্ক, প্রদাহযুক্ত এবং খসখসে করে তোলে। বিভিন্ন গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে ভিটামিন ‘এ’ অ্যাকজিমা থেকে ত্বককে সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
কাজেই, যদি দেখেন যে আপনার ত্বক দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, রুক্ষ্ণ হয়ে যাচ্ছে কিংবা আপনি অ্যাকজিমার মতো রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, তবে ধরে নিতে পারেন যে আপনার শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব দেখা দিয়েছে।
যদি চোখের শুষ্কতা দেখা দেয়
ডাক্তাররা বলে থাকেন, চোখের প্রায় সব ধরণের রোগই ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতির সঙ্গে সম্পর্কিত। চোখের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ভিটামিনটির চূড়ান্ত অভাব চোখের কর্ণিয়াকে মেরে ফেলতে পারে যা বিটল স্পটস্ নামে অভিহিত। এমনকি, ভিটামিন ‘এ’ এর দীর্ঘস্থায়ী ঘাটতি একজন মানুষকে স্থায়ী অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
চোখ শুকিয়ে যাওয়া, চোখে পানি না আসা ভিটামিন ‘এ’ এর অন্যতম অভাব বলেই পরিলক্ষিত হয়। ভারত, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের মধ্যে চোখের শুষ্কতার সমস্যাটি প্রকট আকারে দেখা যায় যা ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবেই হয়ে থাকে।
সুতরাং, যদি খেয়াল করে দেখেন যে আপনার চোখ প্রায়ই শুকিয়ে থাকে, তবে ধরে নিতে পারেন যে আপনার শরীরে চোখের জন্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব দেখা দিয়েছে।
যদি অল্প আলোতে দেখতে সমস্যা হয়
ভিটামিন ‘এ’ এর মারাত্মক রকমের অভাব দেখা দিলে রাতকানা রোগ হওয়ার সমূহ সম্ভাবণা থাকে। রাতের আলোতে কিংবা অল্প আলোতে চোখ ভালভাবে দেখতে পায় না যা রাতকানা রোগের লক্ষণ হিসেবে পরিলক্ষিত।
গবেষণামূলক অনেক রিপোর্টে এসেছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুদের এ ধরনের সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর রাতকানা রোগের মত মারাত্মক চোখের সমস্যা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থাগুলো বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাম্পেইন চালিয়ে থাকে।
আর সে সমস্ত ক্যাম্পেইনে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। সেই সাথে যেসব খাবারে বেশি পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ থাকে, সেসব খাবার সম্পর্কেও অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর মায়েদেরকে বোঝানো হয়ে থাকে।
যদি লক্ষ্য করেন যে রাতে কিংবা অল্প আলোতে আপনার দেখতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আপনার ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব রয়েছে।
প্রজনন সমস্যা এবং সন্তান ধারণে জটিলতা দেখা দিলে
পুরুষ হোক আর মেয়ে হোক, উভয়ের ক্ষেত্রেই ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে প্রজনন সমস্যা দেখা দেয়। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সন্তান ধারণে নানা রকম জটিলতা তৈরি হয়, যদি শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ‘এ’ না থাকে। অন্যদিকে সন্তান ধারণ করা গেলেও ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে গর্ভের সন্তানের সঠিক গ্রোথে সমস্যা দেখা দেয়।
অনেক গবেষণা থেকেই প্রমাণিত হয়েছে যে ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতি গর্ভ ধারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এমনকি, অনেক সময় সন্তান ধারণ সম্ভব হলেও বিকলাঙ্গ সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবণা থাকে।
অন্যান্য কিছু গবেষণা থেকে দেখা গিয়েছে যে, যে সব পূরুষ সন্তান জন্মদানে অক্ষম সে সব পুরুষের প্রচুর পরিমানে এন্টি-অক্সিডেন্ট প্রয়োজন। কারণ, এন্টি-অক্সডেন্টের অভাবে তাদের শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি হয়। আর ভিটামিন ‘এ’ শরীরে এন্টি-অক্সিডেন্টের গুরুত্বপূর্ণ সোর্স হিসেবে কাজ করে।
আপনি যদি পুরুষ হয়ে থাকেন আর সন্তান জন্মদানে আপনার অক্ষমতা থেকে থাকে, তবে বুঝে নিন যে আপনার প্রচুর পরিমাণে এন্টি-অক্সিডেন্ট দরকার যা ভিটামিন ‘এ’ যুক্ত খাদ্যে পাবেন। আর আপনি যদি মহিলা হয়ে থাকেন এবং সন্তান ধারণে আপনার সমস্যা দেখা দেয়, তবে জেনে নিন যে আপনারও ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব রয়েছে। আর শীঘ্রই প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই অভাব দূর করা উচিৎ।
শিশুর শরীর বৃদ্ধিতে বিলম্ব দেখা দিলে
যেসব শিশুর শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘এ’ নেই, সেসব শিশুর শরীর বৃদ্ধিতে দারুণ বিলম্ব হয়ে থাকে। কারণ, মানব শিশুর শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্যে ভিটামিন ‘এ’ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভিটামিন। এমনকি, শিশু মৃত্যু প্রতিরোধেও ভিটামিন ‘এ’ এর প্রয়োজনীয়তা প্রায় সব গবেষণাতেই উঠে এসেছে।
বহু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভিটামিন ‘এ’ সাপ্লিমেন্ট শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। বেশিরভাগ গবেষণায় উন্নয়শীল দেশের শিশুদের উপর পরিচালনা করা হয়েছে এবং প্রায় একই রকম ফলাফল পাওয়া গিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার ১ হাজার শিশুদের উপর গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে, যেসব শিশুদের ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট দেয়া হয়েছে তারা যাদের দেয়া হয়নি তাদের তুলনায় ৪ মাসে ০.১৫ ইঞ্চি বেড়েছে।
ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যদি ভিটামিন ‘এ’ অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের সাথে সাথে দেয়া যায়, তবে বেশি ফলাফল পাওয়া যায়।
আপনার সন্তান যদি ঠিক মতো বেড়ে না ওঠে, যদি মনে করেন যে অন্যান্য শিশুদের তুলনায় তার শরীরের বৃদ্ধিতে বিলম্ব হচ্ছে, তবে আপনার শিশুর অবশ্যই ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব আছে, নিশ্চিত থাকুন।
গলা ও বুকে ইনফেকশন হলে
গলা কিংবা বুকে বারবার ইনফেকশন দেখা দিলে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবই বোঝা যায়। কাজেই রেসপাইরেটোরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশনসহ সব ধরণের ইনফেকশন থেকে রক্ষা পেতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণ করুন।
ক্ষত শুকাতে দেরী হলে
অনাকাংখিত আঘাতে শরীরে যদি কোন ক্ষত হয় আর চিকিৎসার পরও সে ক্ষত শুকোতে দেরী হয়, তবে বুঝে নিন রোগীর শরীরে ঘাটতি রয়েছে ভিটামিন ‘এ’ এর। ক্ষত শুকানোর জন্যে প্রয়োজনীয় কোলাজেন প্রমোট করে থাকে ভিটামিন ‘এ’। চিকিৎসকরা তাই ওরাল হোক আর টপিক্যাল হোক, ক্ষত শুকাতে ভিটামিন এ গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
ব্রণের আধিক্য দেখা দিলে
ভিটামিন ‘এ’ যেহেতু ত্বকের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্য্যকরী ভূমিকা পালন করে, তাই এটি ব্রণ প্রতিরোধে গুরুত্ব রাখে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, মুখে ব্রণের উপস্থিতি ভিটামিন ‘এ’ এর ঘাটতির কারণেই হয়ে থাকে।
২০০০ প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের উপর এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যাদের মুখে ব্রণ নেই, তাদের শরীরে যথেষ্ট্য পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ আছে। আর যাদের মুখে প্রচুর ব্রণ রয়েছে তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব ছিল।
কাজেই, আপনার মুখেও যদি ব্রণের আধিক্য দেখা দেয়, তবে বুঝে নিতে পারেন যে আপনার ভিটামিন ‘এ’ প্রয়োজন।
শেষ কথা
উপরে বর্ণিত ৮টি লক্ষণের কোনটি যদি আপনার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, তবে জেনে নিন যে আপনার দেহে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব রয়েছে। কাজেই, আগে জেনে নিন কোন সব খাবারে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে আর শুরু করে দিন সেসব খাবার গ্রহণ।
Leave a Reply