মাথাব্যথা আমাদের সবারই হয়ে থাকে। এটি এতটাই নিয়মিত যে এটিকে রোগ বলে কেউ মনেই করে না। তবে, মাথাব্যথা আমাদের অনেক কষ্ট দেয় ও আমাদের অনেক সময় নষ্ট করে। তাই, মাথাব্যথা দূর করার উপায় আমাদের অবশ্যই জানা উচিত।
তার আগে মাথাব্যথার ১৫টি কারণ সম্পর্কে জেনে রাখা ভাল। মাথাব্যথা সারাতে আমরা বিভিন্ন প্রকার ঔষধ গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু এই মাথাব্যথা দূর করার সহজ কিছু উপায়ও রয়েছে।
চলুন জেনে নেয়া যাক মাথাব্যথা দূর করার ১৩টি উপায়-
১. ম্যাসেজ থেরাপি
ম্যাসেজ থেরাপি যে শুধু বিলাসপ্রিয় মানুষরা নিয়ে থাকে এ কথাটি ঠিক নয়। মাঝেমধ্যে মাথাব্যথা শরীরের ওপরের অংশে টান পড়ার কারণে হতে পারে। ম্যাসেজ থেরাপি এই টানটাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে এনে বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট মাথাব্যথা দূর করে।
ম্যাসাজ থেরাপি যেসব মাথাব্যথা দূর করে, সেগুলো হলো-
- টেনশনের কারণে মাথাব্যথা।
- কম ঘুমের কারণে সৃষ্ট মাথাব্যথা।
- দীর্ঘক্ষণ চেয়ারে বসে থাকার কারণে মাথাব্যথা।
- মানসিক স্ট্রেস বা উদ্বিগ্নতার কারণে তৈরি হওয়া মাথাব্যথা।
- কম্পিউটার বা মোবাইলের স্ক্রিণে অনেক তাকিয়ে থাকার কারণে যে মাথাব্যথা হয়।
অনেক ধরণের ম্যাসেজ থেরাপি রয়েছে। তবে, শুরুর আগে কোন ধরণের ম্যাসেজ আপনার শরীরের জন্য ভালো বা আপনার মাথাব্যথা কমাতে সাহায্য করবে সে বিষয়ে তদন্ত করে নিবেন।
২. অ্যারোমা থেরাপি
কিছু কিছু সুগন্ধি আপনার মস্তিষ্কে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরী করতে পারে। এর নামই হচ্ছে অ্যারোমা থেরাপি। দেখা গিয়েছে যে, কিছু বিশেষ ধরণের সুগন্ধি মানুষের মস্তিষ্ককে শান্ত করে ও মাথাব্যথা কমিয়ে থাকে।
মাথাব্যথা কমানোর সুগন্ধিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
- গোলমরিচের নির্যাস
- ইউক্যালিপটাস এবং
- ল্যাভেন্ডার তেল।
এই তিনটি পদার্থ আপনি যে কোনো দোকানে পেতে পারেন।
৩. বেশি করে পানি পান করুন
এটি শুনতে যেমন সহজ মনে হয়, তার উপকারিতাও তেমন প্রচুর। অধিকাংশ সময় আমাদের শরীরে পানি শূন্যতার কারণে মাথাব্যথা দেখা দেয়। বেশি পরিমানে কফি পান করলে মাথাব্যথা হতে পারে। আপনার যদি প্রতিদিন সকালে কফি পান করার অভ্যাস থাকে, তাহলে সেই অভ্যাসটাকে আস্তে আস্তে কমিয়ে আনুন। না হলে যে মাথাব্যথার সাথে দেখা হবে প্রতিনিয়ত।
মাদক সেবনেও মাথাব্যথা হয়ে থাকে। তাই, এসব বাদ দিয়ে বেশি করে পানি পান করুন। পানি আপনার শরীরের অনেক বেশি উপকার করবে ও মাথাব্যথা দূর করবে।
পর্যাপ্ত পানি পান যেসব মাথাব্যথা দূর করে-
- মাইগ্রেনের রিলেটেড মাথাব্যথা।
- টেনশন জণিত মাথাব্যথা।
- ক্রনিক টেনশনের কাণের সৃষ্ট মাথাব্যথা।
- সাইনোসাইটিসের কারণে তৈরি হওয়া মাথাব্যথা।
৪. স্ক্যাল্প ম্যাসেজ করুন
মাথার ত্বককে স্ক্যাল্প বলা হয়ে থাকে। স্ক্যাল্প ম্যাসেজ করলে মাথায় রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায় ও তাতে মাথাব্যথা কমে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, ওসিপিটাল নার্ভ (মাথার পেছনের অংশ) ম্যাসেজ করলে মাথাব্যথা কমে যায়। মাথাব্যথা দূর করা ছাড়াও স্ক্যাল্প ম্যাসেজের আরো অনেক উপকার রয়েছে।
স্ক্যাল্প ম্যাসাজের অন্যান্য উপকার-
- চুল পড়া বন্ধ করে, চুলের ঘনত্ব বাড়ায়, চুলের বৃদ্ধি ঘটায়।
- স্ট্রেস ও অ্যাংজাইটি দূর করে।
- ব্লাড সার্কুলেশন বাড়ায়।
- নার্ভাস সিস্টেমের ব্যালান্স ঠিক রাখে।
আপনি চাইলে গোলমরিচ তেল ম্যাসেজ করতে পারেন। গোলমরিচ তেল আপনার চোখের পেছনে কান ও কপালের মধ্যকার স্থানে, কপালে ও চোয়ালের পিছনের দিকে ম্যাসেজ করুন। গোলমরিচ তেল রক্ত সঞ্চালনা বৃদ্ধি করে থাকে।
৫.জলসমৃদ্ধ খাবার খান
যদি আপনার পানিশূন্যতার কারণে মাথাব্যথা হয়ে থেকে, তাহলে জলসমৃদ্ধ খাবার খাবেন। জলসমৃদ্ধ খাবার আপনার শরীর ও মস্তিষ্ককে সতেজ করে তুলবে।
জলসমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
- দুধ,
- আঁখ
- তরমুজ,
- আনারস,
- কমলা,
- আপেল,
- শশা,
- টমেটো, ইত্যাদি।
৫. গভীর নি:শ্বাস নিন
আপনারা হয়তো ভাবছেন যে নিশ্বাস তো আমরা প্রতি মুহূর্তেই নিয়ে থাকি। তাহলে, এটি মাথাব্যথা কমানোর উপায় কিভাবে হতে পারে? আসুন, আপনাদের বুঝিয়ে দেই।
যেসকল মাথাব্যথা অধিক চিন্তার কারণে হয়ে থাকে, সেসব মাথাব্যথা দূর করতে এই উপায়ই অন্যতম। আর প্রতিদিন ব্রিদিং এক্সারসাইজ অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম করলে আপনার শরীর থাকবে সুস্থ ও সতেজ। নি:শ্বাসের ব্যায়াম মাথাব্যথা দূর করার উপায় অসাধারণ।
এই ধরণের ব্যায়ামের জন্য নিজের ঘরে একটি শান্ত জায়গা খুঁজে বের করুন। এমন জায়গায় বসবেন যেখানে আপনি কোনো কিছু দ্বারা বিভ্রান্ত হবেন না। তারপর ৫ সেকেন্ডের জন্য শ্বাস নিন, আবার ৫ সেকেন্ডের জন্য শ্বাস ছাড়ুন। দেখবেন আপনার মাথাব্যথা অনেকটা কমে এসেছে।
গভীর নি:শ্বাস আরো যেসব উপকার করে-
- স্ট্রেস দূর করে শরীর ও মনকে শান্ত করে।
- মাথাব্যথা ছাড়াও শরীরের অন্যান্য নানা ধরণের ব্যথা দূর করে।
- শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্তসঞ্চালন বাড়ায়।
- শরীরের অ্যানার্জি ও মনে উদ্যম সৃষ্টি করে।
- ব্লাড প্রেশার কমায়।
- হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।
৭. পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান
আমরা অনেকসময় শুনে থাকি যে ঘুমের অভাবে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনার মাথাব্যথাও এই ঘুমের অভাবের কারণেই হয়ে থাকতে পারে। তাই সঠিক পরিমানের ঘুম সবার জন্যই জরুরি।
ভালো ঘুমের জন্য আপনার নিম্নোক্ত জিনিসগুলো করা উচিত:
- ঘুমানোর সময়সূচির দিকে খেয়াল রাখবেন। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যাবেন। সময়ের কিছুক্ষন আগেই শুতে যাবেন যাতে একটু দেরিতে ঘুম ধরলেও যেন সময়মতো উঠতে পারেন।
- ঘুমানোর আগে ক্যাফেইন জাতীয় খাবার বর্জন করবেন।
- ঘুমানোর অন্তত আধ ঘন্টা আগে মোবাইল দূরে সরিয়ে রাখবেন।
- ভালো ঘুমের জন্য ঘুমানোর আগে আরামদায়ক কিছু করতে পারেন। যেমন-বই পড়া, ডায়েরি লিখা ইত্যাদি।
এছাড়াও, ঘুমের জন্যে প্রয়োজনীয় ভিটামিন সম্পর্কে জেনে নিয়ে প্রাকৃতিক খাবারের মাধ্যমে সেগুলো গ্রহণ করুন।
৭. আদার চা পান করুন
আদার চায়ের মধ্যে এন্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ রয়েছে যা আপনার মাথাব্যথা কিছুটা হলেও কমাবে। শুধু আদার চা’ই নয়, বরং যেকোনো ভেষজ চা আপনার মাথাব্যথা কমাতে সাহায্য করবে।
তবে, ভেষজ চা গ্রহণের আগে ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেয়া উচিত। কারণ, যদি চায়ের কোনো ভেষজ উপাদানের সাথে এলার্জি থাকে, তাহলে আপনার সমস্যা হতে পারে। আর ডাক্তারি পরামর্শে যেতে না চাইলে, আদার চা’ই আপনার জন্যে বেশি ভাল।
আদার চায়ের আরো কিছু উপকার-
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- বমি বমি ভাব দূর করে।
- হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
- কাঁটা-ছেঁড়া জণিত ক্ষত শুকোতে সাহায্য করে।
- মাসিকের অস্বস্তি দূর করে।
৮. হিস্টামিন সমৃদ্ধ খাবার বর্জন করুন
হিস্টামিন এক ধরণের রাসায়নিক যা মানুষের শরীরে পাওয়া যায়। এটি বিভিন্ন ধরণের খাবারেও পাওয়া যায়।
হিস্টামিন সমৃদ্ধ কয়েকটি খাবার-
- পনির,
- ওয়াইন,
- বিয়ার ইত্যাদি।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, হিস্টামিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে মাইগ্রেন হওয়ার সম্ভাবনা অধিকতর। তাই, যাদের ঘন ঘন মাথাব্যথা হয়ে থাকে, তাদের এসব খাবার বর্জন করাই শ্রেয়।
৯. যোগব্যায়াম করুন
যোগব্যায়াম স্ট্রেস, মাথাব্যথা কমিয়ে থাকে। তাছাড়া যোগব্যায়াম আপনার পেশির নমনীয়তা বৃদ্ধি করে এবং ব্যথা কমিয়ে থাকে। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যোগব্যায়াম ক্রনিক মাইগ্রেনের রোগীদের জন্য খুব উপকারী।
আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, যারা ৩ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে যোগব্যায়াম চর্চা করেছে, তাদের মাথাব্যথার প্রখরতা শত গুনে কমেছে। সত্যিকার অর্থেই যোগব্যায়াম মাথাব্যথা দূর করার উপায় গুলোর মধ্যে অন্যতম। যোগব্যায়াম যে শুধু মাথাব্যথার জন্য উপকারী তা কিন্তু নয়, এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্যও খুব উপকারী।
মাথাব্যথা কমানো ছাড়াও যোগব্যায়ামের আরো কিছু উপকারিতা-
- শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ায়।
- পেশীশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- খাদ্য বিপাক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে।
- অযাচিত আঘাত থেকে রক্ষা করে।
১০. গরম কিংবা ঠান্ডা পানি ব্যবহার করুন
চোখের পেছনে কান ও কপালের মধ্যকার স্থানে বরফ মালিশ করুন। যে রক্তনালী মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন করে, তা এই জায়গায় থাকে। মাইগ্রেনের সময় এই রক্তনালিটা ফুলে যায়। তাই, বরফ মালিশ করে রক্তের তাপমাত্রা কমাতে হয়, তাতে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়।
অথবা গরম পানি দিয়ে গোসল করুন। পানিকে আপনার গর্দানের পেছনে পড়তে দিন। এই তাপ আপনার পেশিকে আরাম দিবে ও মাথাব্যথা কমাবে।
১১. ঝাল কিছু খান
আপনি হয়তো ভাবছেন ঝাল কিছু খাওয়ার সাথে আবার মাথাব্যথার কি সম্পর্ক?
অবশ্যই সম্পর্ক আছে। ঝাল খাবারের কিছু উপাদান আমাদের ব্যথা উপলব্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই, নিজের খাবারে গোলমরিচের গোড়া ছিটিয়ে খান।
গোলমরিচে ক্যাপসাইসিন নামক একটি উপাদান রয়েছে যা আমাদের ব্যথা উপলদ্ধির ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে।
১২. আপেল সিডার ভিনেগার পান করুন
দুই চামচ আপেল সিডার ভিনেগার পানিতে মিশিয়ে একটু মধু বা লেবুর রস দিন যাতে স্বাদ ভালো হয়। আপেল সিডার ভিনেগার আপনার শরীরের অ্যাসিড-ক্ষারীয় ভারসাম্য ফিরিয়ে আনবে ও মাথাব্যথা কমাবে।
১৩. ঘাড় টানুন
কথাটি হাস্যকর বটে। তবে, এর উপকারিতাও কিন্তু কম নয়। অনেক সময় কাল পেশির কারণে মাথাব্যথা হয়ে থাকে। তাই, ঘাড় টানলে মাথাব্যথা কমার সম্ভাবনা অধিকতর। অনেক সময়ই আমাদের আশেপাশের অনেককেই ঘাড় টানতে দেখা যায়। আমরাও যখন ক্লান্ত থাকি, তখন মনের অজান্তেই ঘাড় টানা শুরু করি। তাই, এই উপায়টিকে উপেক্ষা করবেন না।
মাথাব্যথায় আমরা প্রতিনিয়ত ভোগী। তাই মাথাব্যথা দূর করার উপায় হিসেবে বারবার ঔষধ খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখুন। কারণ পেইন-কিলার ঔষধ আমাদের কিডনির জন্য ক্ষতিকর। তাই, দ্রুত মাথাব্যথা দূর করার জন্যে হিসেবে উপরের ১৩টি সহজ উপায় চেষ্টা করতে ভুলবেন না।
Jasmin says
মাথাব্যথা এমন একটি কমোন প্রোবলেম যা প্রায় সকল মানুষেরই রয়েছে। কিন্তু সবাই মাথাব্যথা দূর করার উপায় জানে না, হৈচৈ বাংলা দারুণ কিছু উপায় জানিয়েছে, তাই ধন্যবাদ।