মশার কামড়ে যেসব রোগ হয় সেগুলোর মধ্যে আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ম্যালেরিয়া। গত কয়েক বছরে মশার কামড়ে সৃষ্ট ডেঙ্গু রোগটিও আমাদের কাছে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। আর সাম্প্রতিক সময়ে মশা বাহিত যে রোগটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হচ্ছে চিকনগুনিয়া। কিন্তু এগুলো ছাড়াও আরো অনেক রোগ রয়েছে যেগুলো মশার কামড়ে আমাদের শরীরে ছড়াচ্ছে এবং অত্যন্ত ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে।
আকারে ছোট হলেও পৃথিবী জুড়ে অত্যন্ত ভয়ংকর একটা প্রাণী হচ্ছে মশা। প্রতি বছর মশার কামড়ে অর্থাৎ মশার কামড় থেকে সৃষ্ট রোগে লাখ লাখ মানুষ মারা যায় বলে জানিয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত স্বাস্থ্য সংস্থাগুলো। মশা থেকে সৃষ্ট রোগ ম্যালেরিয়া থেকেই গত বছর পৃথিবী জুড়ে ৪ লক্ষ ৩৮ হাজার লোক মারা গিয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশন (WHO)।
মশা বহুল এলাকায় থাকা এবং মশার ঘ্যানঘ্যানানি সহ্য করা যে কী বিরক্তিকর তা আমাদের প্রায় সবাই জানেন। যে কারণে এই ছোট প্রাণীটি অত্যন্ত ভয়ানক তা হচ্ছে এর কামড়ে মানুষের শরীরে ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস ও পরজীবি ঢুকে পড়ে যেগুলো থেকে নানা ধরণের রোগের সঞ্চার হয়। আসুন, মশা বাহিত ১০টি রোগ সম্পর্কে জানি।
মশার কামড়ে যেসব রোগ হয়
মশারাও প্রেমে পড়ে – মশা সম্পর্কে এ রকম ১০টি মজার তথ্য রয়েছে। পৃথিবীতে ৩ হাজার ৫ শতাধিক প্রজাতির মশা রয়েছে বলে এ যাবৎ পর্যন্ত জানা গিয়েছে। আর এসব মশা থেকে অসংখ্য রোগ আমাদের শরীরে বাসা বাঁধছে যার মাঝ থেকে অন্যতম ১০টি সম্পর্কে আজ আলোচনা করবো।
১. লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিস
উছেরেরিয়া ব্যানক্রপট, ব্রুগিয়া মালায়ী এবং ব্রুগিয়া ট্রিমোরী নামক তিন ধরণের ভাইরাস থেকে আমাদের শরীরে এই বিরল রোগটি সৃষ্টি হয়। আর এই সব প্যারাসিটিক ফিলারিয়াল ভাইরাসের সবগুলোই আসে মশার কামড় থেকে। অ্যানেফিলিস মশার কামড়ের দ্বারা উপরোক্ত ৩টি ভাইরাসের যে কোনটি শরীরে প্রবেশ করলেই লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিস নামক রোগ দ্বারা মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে।
এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির লিম্ফ্যাটিক সিস্টেম ডেমেজ হয়ে পড়ে এবং শরীরের কোন একটা কিংবা একাধিক অংশ অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায়। সেই সাথে শরীর অথর্ব হয়ে পড়ে, স্বাভাবিক চলাফেরা বন্ধ হয়ে যায়, বড় হয়ে যাওয়া স্থানে মারাত্মক ব্যাথা অনুভূত হয় আর রোগী সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ ধরণের রোগী শুধু শারীরিকভাবেই নয়, বরং মানসিকভাবেও মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে যায়।
গত বছর পর্যন্ত পৃথিবীতে লিম্ফ্যাটিক ফিলারিয়াসিস রোগে আক্রান্ত ১২০ মিলিয়ন লোক পাওয়া গিয়েছে। বর্তমানে ৫২টি দেশে ৮৮৬ মিলিয়ন লোক এই রোগের হুমকির মধ্যে আছে। এ রোগের মূল চিকিৎসা ক্যামো-থেরাপি আর এ পর্যন্ত ক্যামো-থেরাপির মাধ্যমে বহু লোককে এ রোগ থেকে মুক্ত করা গিয়েছে। তবু, আশংকা কাটছে না, ভবিষ্যতে এ রোগের বিস্তার আরো বাড়তে পারে। তাই, মশার কামড় থেকে সাবধাণতা অবলম্বণ করা জরুরী। মশা তাড়ানোর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ ব্যবহার করে এডিস, অ্যানেফিলিসসহ সব ধরণের মশা থেকেই কিছুটা মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
২. মশার কামড় থেকে ম্যালেরিয়া
মশার কামড় থেকে যেসব রোগ হয় তার মাঝে ম্যালেরিয়া অন্যতম, এটি মানুষের জন্যে একটি প্রাণঘাতি রোগ। প্লাজমোডিয়াম নামক এক ধরণের পরজীবি থেকে এই মারাত্মক রোগটির সৃষ্টি হয়। আর বিশেষ এই পরজীবিটি বহন Anopheles নামক স্ত্রী মশা যার কামড় থেকে আমাদের শরীরে এটি ঢুকে পড়ে।
মশার কামড়ের সাথে সাথে প্লাজমোডিয়াম পরজীবিটি আমাদের শরীরে ঢুকে সরাসরি লিভারে চলে যায়। আর অল্প সময়ের মধ্যেই বংশ বিস্তার শুরু করে। অর্থাৎ একটা প্লাজমোডিয়াম থেকে অসংখ্য প্লাজমোডিয়ামের সৃষ্টি হয় এবং সেগুলো মূলত আমাদের রক্তের লোহিত কণিকায় আক্রমণ করে। ফলে, জ্বর, মাথা-ব্যাথা এবং বমির মতো লক্ষণ দেখা দেয়।
জ্বর বা মাথা-ব্যথার তীব্রতা নির্ভর করে কি ধরণের প্লাজমোডিয়াম থেকে ম্যালেরিয়া হয়েছে তার উপর। প্রকৃতিতে প্রায় ১০০ ধরণের প্লাজমোডিয়াম পরজীবি রয়েছে এবং এগুলোর মধ্যে ৫টি রয়েছে মশার শরীরে। আর মশার কামড় থেকে এই ৫টির যে কোনটিই ঢুকে পড়তে পারে আমাদের শরীরে। ভিন্ন ভিন্ন পরজীবির কারণে ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণও দেখা দিয়ে থাকে। তবে চিন্তার কিছু নেই ম্যালেরিয়া দমনে নতুন ধরণের টিকা আবিস্কৃত হয়েছে।
৩. জাপানিজ এনসেফালিটিস
নাম দেখে মনে করবেন না যে এ রোগটি কেবল জাপানেই হয়। বরং মশার কামড় থেকে সৃষ্ট এ রোগটি পৃথিবীর সব দেশের মানুষের মাঝেই হয়। এনসেফালিটিস এক ধরণের মস্তিস্ক প্রদাহ আর এটি ১৯৯১ সালে সর্ব প্রথম জাপানেই আবিস্কৃত হয়েছে বলে এর নাম জাপানিজ এনসেফালিটিস।
যে সব দেশে প্রচুর পরিমাণে ধান হয়, এ রোগটি সেসব দেশেই বেশি দেখা যায়। অর্থাৎ, এ রোগের জন্যে দায়ী ভাইরাস, জে.ই মূলত ধান গাছে জন্ম নিয়ে থাকে। এছাড়াও, খড়কুটো এবং যে কোন গাছের পাশে আবদ্ধ পানিতেও জে.ই ভাইরাস জন্ম নেয়।
প্রায় সব ধরণের মশাই এই ভাইরাসটি বহন করে থাকে। আর মশার কামড়ের মাধ্যমে যখন মানুষের শরীরে এই ভাইরাসটি প্রবেশ করে, তখন সেটি সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমে গিয়ে আক্রমণ করে থাকে। যারফলে, মানুষের মস্তিস্ক এবং স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
অধিকাংশ জে.ই ভাইরাসের আক্রমণই প্রথম প্রথম টের পাওয়া যায় না। কারণ, লক্ষণগুলো দেরীতে প্রকাশ পায় এবং খুব বড় ধরণের কোনও লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সাধারণত ৫ থেকে ১৫ দিনের মাথায় জ্বর আসা, মাথা ব্যাথা হওয়া, বমি এবং যে কোন কিছু নিয়ে কনফিউশন তৈরি হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। সুতরাং, মশার কামড়ে যেসব রোগ হয় সেগুলোর মাঝে জাপানিজ এনসেফালিটিস অন্যতম।
এ রোগের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিকটি হচ্ছে মস্তিস্কের প্রদাহ। এ রোগে আক্রান্ত হলে মস্তিস্কের চারপাশে ঘাম ঝরতে থাকে যা থেকে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। রোগী তখন নানা রকম মানসিক সমস্যায় পড়তে থাকে। সুখবর হচ্ছে, জাপানিজ এনসেফালিটিস রোগের টীকা আবিস্কৃত হয়েছে যা গ্রহণের মাধ্যমে এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
৪. ডেঙ্গু জ্বর
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসের নাম আর এই ভাইরাস থেকে সৃষ্ট জ্বরকেই ডেঙ্গু জ্বর বলে। মশার কামড় থেকে যেসব রোগ হয় সেগুলোর মধ্যে এটি অত্যন্ত পরিচিত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এডিস অজিপ্তি নামক স্ত্রী মশা থেকে আমাদের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ঢুকে থাকে। তবে, অল্প ক্ষেত্রে হলেও অ্যালবোপিকটাস নামক আরেকটি স্ত্রী মশা থেকেও ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে।
ডেঙ্গু জ্বর হলে সাধারণত জ্বরের উচ্চ প্রকোপের সাথে সাথে মারাত্মক মাথা ব্যাথা, হাঁড় ও মাংশপেশীতে ব্যথা এবং মাঝে মাঝে নাক দিয়ে রক্ত পড়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়। বিশেষ করে ডেঙ্গু রোগীর ছোট ছোট রক্তনালিগুলোর মধ্যে কোন কোনটি যদি লিক হয়ে যায় আর সেখান থেকে পেট ও ফুসফুসে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে, তখনই নাক দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করে।
কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে আরো মারাত্মক অবস্থা, যেমন ডেঙ্গু হেমোর্যাজিক জ্বর দেখা দিতে পারে। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর কিংবা হেমোর্যাজিক ডেঙ্গু জ্বর উভয় অবস্থাতেই দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে। নচেৎ রোগীকে বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাবে। আর চিকিৎসার পাশাপাশি পুরোপুরি রেস্ট নেয়াই হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর জন্যে বেস্ট অ্যাডভাইস। আর আমাদের চারপাশে ডেঙ্গু প্রতিরোধের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে ডেঙ্গু মশার ডিম ধ্বংস করার উপায় শিখে নেয়া এবং অ্যাপ্লাই করা।
প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে ৩৫০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৩৫ কোটি লোক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এর মাঝে প্রায় ৯৬ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ৬০ লক্ষ লোক মারাত্মক অবস্থায় পড়ে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পৃথিবীর ট্রিফিক্যাল এরিয়াগুলোতে এ রোগটি বেশি দেখা দেয়। যেমন আফ্রিকা, এশিয়া, প্যাসিফিক আইল্যান্ড, সেন্ট্রাল সাউথ আফ্রিকা এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চল।
৫. ইয়ালো ফিভার বা হলুদ জ্বর
ইয়ালো ফিভার একটি হ্যামোরেজিক রোগ যা আক্রান্ত মশার কামড় থেকে মানুষের শরীরে প্রবাহিত হয়। এই রোগের নামের মধ্যে ইয়ালো বা হলুদ শব্দটি মূলত জন্ডিসকে নির্দেশ করে। কারণ, এই জ্বরে আক্রান্ত রোগীর জ্বরের সাথে জন্ডিস দেখা দেখা দিয়ে থাকে। সেই সাথে শরীর ব্যাথা, মাথা ব্যাথা, সর্দিকাশি এবং বমিও হয়ে থাকে।
ফ্ল্যাবোভাইরাসের একটি জাত আর্বোভাইরাইস থেকে হলুদ জ্বর হয়ে থাকে। আর এ ভাইরাসটি সাধারণত এডিস এবং হ্যামোগোগাস নামক স্ত্রী মশারা বহন করে থাকে। আর এই দুই প্রজাতির মশারা মানুষের শরীর থেকে রক্ত চোষার সময় শরীরে আর্বোভাইরাইস প্রবাহিত করে দেয় যা থেকে ইয়ালো ফিভার দেখা দেয়। ভয়ের বিষয় হচ্ছে, জনবহুল এলাকাতেই আক্রান্ত মশারা বাস করে এবং মানুষ থেকে মানুষে দ্রুত এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ে।
অধিকাংশ ইয়ালো ফিভারে আক্রান্ত রোগী প্রাথমিকভাবে কিছুই বুঝতে পারে না। কেবল তারা খুব সাধারণ একটা ফ্লু এবং সেই সাথে শারীরিক দূর্বলতা অনুভব করে। এ রোগের জন্যে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য কোন অ্যান্টি-ভাইরাল ঔষধ নেই। তবে, রোগীকে রেস্টে রাখা সুস্থ্যতার জন্যে অনেক কাজে দেয়।
অধিকাংশ হলুদ জ্বর আক্রান্ত রোগী সাধারণ চিকিৎসা ও বিশ্রামের মাধ্যমে ভাল হয়ে যায়। তবে, যাদের মারাত্মক জ্বর থাকে তাদের মাঝে অর্ধেকের মতো রোগী ৭ থেকে ১০ দিনের ভেতর মারা যায়। এ রোগের জন্যে অত্যন্ত কার্য্যকর টিকা আবিস্কৃত হয়েছে যা নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী। অধিকাংশ রোগীর ক্ষেত্রেই একটি সিঙ্গেল ডোজ টিকাই যথেষ্ট্য যা তাকে আজীবনের জন্যে এ রোগ রক্ষা করবে। সাধারণত টিকা নেয়ার ১০ দিনের মধেই ৮০ থেকে ১০০ ভাগ রোগী সুস্থ্য হয়ে ওঠে। আর অল্প কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ৩০ দিনের মতো লেগে যায়।
৬. মশার কামড়ে চিকনগুনিয়া
মশা থেকে সৃষ্ট আরেকটি মারাত্মক রোগ হচ্ছে চিকনগুনিয়া। যেসব মশা এডিস অজিপ্তি এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস মশা দ্বারা ইনফেকটেড হয়, সেসব মশার কামড় থেকেই আমাদের শরীরে চিকনগুনিয়া দেখা দেয়। এডিস অজিপ্তিকে ইয়ালো ফিভার মসকিটো আর এডিস অ্যালবোপিকটাসকে এশিয়ান টাইগার মসকিটো বলা হয়ে থাকে। এ দু’টির যে কোনও একটি মশা থেকে যদি একটি সাধারণ মশা আক্রান্ত হয়, আর ঐ মশাটি যদি মানুষের শরীরে কামড় বসায়, তবে অবশ্যই তার চিকনগুনিয়া হয়।
চিকনগুনিয়া একটি মশা বাহিত ভাইরাস আর এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর জ্বর ও জয়েন্ট পেইনের মতো লক্ষণ দেখা যায়। আরো লক্ষণের মধ্যে রয়েছে মাথা ব্যাথা ও মাসল পেইন। সেই সাথে শরীরে ফুসকুড়ি উঠা।
সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসার মাধ্যমে আক্রান্ত রোগী ভাল হয়ে যায়। তবে, জয়েন্ট পেইনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সুস্থ্য হতে এক মাসের মতো লেগে যেতে পারে। সাধারণত ছোটরা আর বৃদ্ধরা চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে কিছুটা রিস্কে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশনের জরিপ অনুযায়ী পৃথিবীতে প্রতি ১০০০ জন চিকনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মাঝে এক জন মারা যায়।
২০১৩ সালে সর্ব প্রথম আফ্রিকায় চিকনগুনিয়া ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত চিকনগুনিয়ার কোন ভ্যাকসিন তৈরি হয়নি। তবে, বিশ্ব বিখ্যাত প্রায় সব মেডিকেল অর্গানাইজেশনগুলোই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আপাতত: রোগটি চিকিৎসাতেই সীমাবদ্ধ থাকলেও চিকনগুনিয়ার প্রকোপ থেকে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, মশার কামড়ে যেসব রোগ হয় সেগুলোর মধ্যে এটি তেমন মারাত্মক নয়।
৭. ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস
মশার কামড়ে যেসব রোগ হয় হয় তার মাঝে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ রোগ ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস। এটি একটি সিঙ্গেল স্ট্যান্ডার্ড আর.এন.এ ভাইরাস যা ফ্ল্যাভিভিরিডি পরিবারের সদস্য। জিকা ভাইরাস, ডেঙ্গু ভাইরাস ও ইয়ালো ফিভার ভাইরাসের জন্যে যে ফ্ল্যাভোভাইরাসটি দায়ী, সেটিই মূলত ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস বহন করে থাকে। এই ভাইরাসটিও ইনফেকটেড স্ত্রী মশার কামড় দ্বারাই মানুষের শরীরে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে কিউলেক্স মশারাই এই ভাইরাসটি পাখি এবং মানুষের শরীরে কামড়ের দ্বারা প্রবাহিত করে দেয়।
ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত অন্যান্য মশাবাহিত রোগের মতোই মাথা ব্যাথা ও জ্বরে ভুগে থাকে। ব্যতিক্রম শুধু এই যে রোগীর শরীর মারাত্মক চুলকানি দেখা দেয়। কোন কোন রোগীর ক্ষেত্রে ত্বকে ফুসকুড়ি উঠে। আবার, কারো কারো ক্ষেত্রে ঘুমের সমস্যা হয়। অর্থাৎ রোগী স্লিপিং ডিসঅর্ডারে ভুগে থাকে।
৮. জিকা ভাইরাস
জিকা ভাইরাসও মশার মাধ্যমেই আমাদের শরীরে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আর এ ভাইরাসটিও এডিস মশা থেকেই আসে। তবে, জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর তেমন বড় ধরণের কোন লক্ষণ দেখা দেয় না। কেবল, হাল্কা জ্বর, মাথা ব্যাথা, আর হাঁড় ব্যাথাই মূল লক্ষণ এবং এগুলো চিকিৎসার মাধ্যমে খুব দ্রুত সেরে যায়।
তবে, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা হয় জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে। বিশেষ করে যেসব শিশুরা জন্মগুতভাবেই মায়ের শরীর থেকে জিকা ভাইরাস বহন করে থাকে। ঠিক এ কারণেই জিকা ভাইরাসকে গ্লোবাল পাবলিক হেলথ্ ইমার্জেন্সি হিসেবে ঘোষণা করেছে ওয়ার্ল্ড হেলথ্ অর্গানাইজেশন। কারণ, মেডিকেল সায়েন্স প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে, জিকা ভাইরাস Microcephaly নামক এক ধরণের দূর্লভ নিউরোলোজিক্যাল ডিজঅর্ডার তৈরি করে। যারফলে, জন্মক্রুটি নিয়ে অনেক শিশু পৃথিবীতে আসে। বিশেষ করে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের গর্ভ থেকে যে শিশুর জন্ম হয় তার মাথা অনেক ছোট থাকে এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি হয় না।
এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোন ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে, অচিরেই হবে বলে আশাবাদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মেডিকেল অর্গানাইজেশনগুলো।
৯. এনসেফাইলাইটিস
মশা তার রক্ত শোষণের প্রয়োজনে আমাদের শরীরে যে কামড় বসিয়ে দেয়, তা থেকে এমন এক ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করতে পারে যা আমাদের ব্রেনের চারপাশে প্রদাহ বা ক্ষত সৃষ্টি করতে পারে। একেই বলে এনসেফাইলাইটিস যার মানে মস্তিস্ক প্রদাহ। এটি প্রদাহ সৃষ্টি করা ছাড়াও ব্রেনের স্পাইনাল কর্ডেরও ক্ষতি করে থাকে। এর থেকে জ্বর আসা ও গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো আরো কিছু উপসর্গ দেখা দেয়।
এনসেফাইলাইটিস ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসেরই একটি জাত। এ রোগটি সবচেয়ে বেশি দেখা দেয় অ্যামেরিকায়, বিশেষ করে মিসিসিপি নদীর আশে-পাশের এলাকাগুলোতে। অ্যামেরিকার ফ্লোরিডা ও মেক্সিকোতেও এ রোগ বহনকারী প্রচুর মশা রয়েছে। এশিয়া ও ওয়েস্টার্ন প্যাসিফিক, বিশেষ করে জাপানে এ রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হলেও, আমাদের দেশে খুবই কম দেখা যায়।
১০. রোস রিভার ফিভার
মশা বাহিত আরেকটি ব্যতিক্রমী ও বিরল রোগ হচ্ছে রোস রিভার ফিভার। তবে, ইউএস সেন্টার ফর ডিজেজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের মতে, এ রোগে আক্রান্ত ৫৫ থেকে ৭৫ পার্সেন্ট রোগী কোন অসুস্থতাই বোধ করে না।
যারা অসুস্থতা বোধ করে তাদের মাঝে হাঁড়ের ব্যাথা ও মাংশপেশীর ব্যাথার কথাই বেশি শোনা যায়। কোন কোন রোগীর বেলায় জ্বর আসা এবং শারীরিক দূর্বলতা দেখা দেয়। মশা থেকে সৃষ্ট রোগের মধ্যে এটিই তাড়াতাড়ি ভাল হয় এবং কোনও ঔষধের প্রয়োজন হয় না। শুধু মাত্র রেস্ট নেয়াই যথেষ্ট্য।
রোস রিভার ফিভার বেশি দেখা দেয় অস্ট্রেলিয়া, পাপুয়া নিউগিনি ও ইন্দোনেশিয়ার কিছু কিছু অঞ্চলে। আমাদের দেশে এ রোগটি রেয়ার।
মশার কামড়ে যেসব রোগ হয় হয় সেগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানলেন। এর বাইরেও আরো কিছু মশা বাহিত রোগ আছে। যেহেতু সেসব রোগে মানুষের তেমন কোনও ক্ষতি হয় না, তাই সেগুলো আলোচনায় আনা হলো না। এই ১০টি রোগ থেকে বেচে থাকতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মশার কামড় থেকে বেচে থাকতে হবে।
Leave a Reply