যে কোনও বই নিষিদ্ধ করা হয় এই জন্যে যে, যাতে ওই বইটা মানুষ হাতে না পায় এবং পড়তে না পারে। কিন্তু ঘটনা ঘটে তার উল্টোটা। যে বইটি নিষিদ্ধ হয়, যে কারণেই হোক না কেন, সে বইটি পড়ার জন্যেই পাঠক মন মরিয়া হয়ে ওঠে।
কোনও বই নিষিদ্ধ হওয়ার পর কৌতুহলী মন মানুষকে ভীষণভাবে প্ররোচিত করে ওই বইটি সংগ্রহ করার জন্যে এবং তাতে কী আছে তা জানার জন্যে। উল্টো ফল হিসেবে দেখা যায়, বিশেষ ওই বইটির প্রচার-প্রসার বেড়ে যায়। চলতি ভাষায় বলতে গেলে, বইটি হিট খায়!
প্রকৃত লেখক যদিও হিট খাওয়ার জন্যে বই লেখেন না, তবু এটা তাকে যারপরনাই আনন্দিত করে। কিন্তু, বইটি যখন নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, তখন লেখকের দিলে যে চোট লাগে তা বাইরের কারো বোঝার সাধ্য নেই। এ-রকম চোট খেয়েছেন বাংলাদেশের বহু লেখক।
রাজনৈতিক পরিক্রমায় কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখকের অনেকগুলো বই নিষিদ্ধ করা হয়। এরমধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমানের বইসমূহ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিনের বই সবচেয়ে বেশি নিষিদ্ধ। তসলিমা নাসরিনের ছয়টি , হুমায়ুন আজাদের দুইটি এবং মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমানের একটি বই নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে আরো কিছু নতুন লেখকের বই। আসুন, নিষিদ্ধ এই বইগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
বাংলাদেশের নিষিদ্ধ বই
বই পড়া যে শুধু আনন্দের তা নয়, বরং পেশাগত জীবনে উন্নতি কিংবা ব্যক্তি জীবনে সফলতার ক্ষেত্রেও বইয়ের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। জীবনে যে ৭টি উন্নতির জন্যে সকলেরই বই পড়া প্রয়োজন, তা এখন অনেক মানুষই জানেন। তবে, বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ হওয়া বইগুলো সম্পর্কে সবাই হয়তো ভালভাবে জানে না। তাই, তাদের জন্যে এই লেখা যেখান থেকে ১০টি নিষিদ্ধ বই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
১. বিষফোঁড়া – কওমি মাদ্রাসার শিশু ধর্ষণ উপাখ্যান
- লেখক: সাইফুল বাতেন টিটো
- প্রকাশক: ইস্টিশন
- প্রকাশকাল: ২০২০
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২০২০
বিষফোঁড়া সাইফুল বাতেন টিটোর প্রথম উপন্যাস বা উপাখ্যান, প্রকাশিত প্রথম বই। আর প্রথম বইটি নিষিদ্ধ হয় প্রকাশিত হওয়ার প্রথম বছরই! ২০২০ সালের বইমেলায় আসা এই বইটির প্রেক্ষাপট বা প্লট হচ্ছে কওমি মাদ্রাসা, যা ধর্ষণ ও বলাৎকারের বিশাল এক আখড়া হয়ে উঠেছে। আর এই আখড়ার ভেতর বাহির নিয়ে গবেষণাধর্মী উপন্যাস এটি।
বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসার শিশু ছাত্র বলাৎকারের বহু ঘটনা এদেশের মানুষ পত্র-পত্রিকায় দেখেছে বা পড়েছে। কিন্তু, লেখকের মতে এটা হচ্ছে যতগুলো ঘটনা ঘটে তার ০.০১ ভাগ। এটা লেখকের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত একটা সম্ভাব্য পরিসংখ্যান।
এই উপখ্যানটি লিখতে গিয়ে লেখক শহর ও গ্রামের অনেক কওমি মাদ্রাসা পরিদর্শন করেছেন, ধর্ষিত বা বলাৎকারের শিকার বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এমনকি, মাদ্রাসার অন্যান্য ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। আর সবার কথা, কওমির করুণ দশা, কারণ ও অন্যান্য নানা বিষয় নিয়েই তিনি এই উপন্যাসটি লিখেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ বইটিকে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ‘বিষফোঁড়া’ নিষিদ্ধ করে।
২. দিয়া আরেফিন’র নানীর বাণী
- লেখক: দিয়ার্ষি আরাগ
- প্রকাশক: সৃষ্টিঘর প্রকাশনা
- প্রকাশকাল: ২০২০
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২০২০
‘বিষফোঁড়া’-র মতো ‘দিয়া আরেফিন’র নানীর বাণী’-ও এমন একটি বই যা প্রকাশনার বছরই ব্যানড্ হয়ে যায়। ২০২০ সালের একুশে বইমেলায় দিয়ার্ষি আরাগের দু’টি বই প্রকাশিত হয় যার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘দিয়া আরেফিন’র নানীর বাণী’ আর অন্যটি হচ্ছে ‘দিয়া আরেফিন’।
এ দু’টি বইয়ের বিরুদ্ধেই ধর্মীয় অনুভূতিতে, বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ ওঠে। যারফলে, প্রকাশনার বছরই বই দু’টি সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। শুধু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়াই নয়, বই দুটির বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ রয়েছে যে, বইয়ের লেখা ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশেষ পরিপন্থী ও ভীষণরকম বিদ্বেষমূলক।
দিয়ার্ষি আরাগ একজন ব্লগার হিসেবেই বেশি পরিচিত। লেখা-লেখির ক্ষেত্রে ফেসবুকেও তার তুমুল অ্যাক্টিভিটি রয়েছে। অমর একুশে বইমেলা, ২০২০-এ প্রকাশিত তার এই দুটি বই নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আজহার উল্লাহ ভূইঁয়া (সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী) আদালতের কাছে আবেদন জানান। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে যাছাই করে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ (যার নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি এম, ইনায়েতুর রহিম) বই দুটি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেন।
৩. রেভোলিউশন, মিলিটারি পারসোনেল অ্যান্ড দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ইন বাংলাদেশ
- লেখক: কর্নেল (অব.) অলি আহমদ
- প্রকাশক: অন্বেষা প্রকাশন
- প্রকাশকাল: ২০০৮
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২০২০
কর্নেল (অব.) অলি আহমদ একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাকে বাংলাদেশের এই অঙ্গণের লোকজন কর্নেল অলি নামেই চেনেন। লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)-এর চেয়ারম্যান তিনি। এই পার্টির হয়েই ২০ দলীয় ঐক্যজোটে জয়েন করেছিলেন তিনি এবং বিনএনপির শাসণামলে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, গল্প ও কবিতা নিয়ে লিখিত ও প্রকাশিত “রেভোলিউশন, মিলিটারি পারসোনেল অ্যান্ড দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ইন বাংলাদেশ” বইটি কর্ণেল অলির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়য়ক প্রবন্ধ গ্রন্থ। কর্ণেল অলি ছিলেন বাংলাদেশের মহান এক মুক্তিযোদ্ধা, জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার অন্যতম স্বাক্ষী, বীরের বেশে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্যে তাকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী ইতিহাস নিয়েই বইটি লেখেন তিনি।
কিন্তু এই বইতে তিনি বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম ঘোষণাসহ আরো কিছু ইতিহাস বিকৃতি করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। যারফলে, ৯ ডিসেম্বর ২০২০ সালে কর্ণেল অলির বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, হাইকোর্ট।
তসলিমা নাসরিনের নিষিদ্ধ ৬ বই
আশির দশকে দূর্দান্ত লেখনী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করা তসলিমা নাসরিনের ৬টি বই নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। চিকিৎসক থেকে কবি, উপন্যাসিক, নারীবাদী লেখিকা হিসেবে সাহিত্য অঙ্গেন প্রবেশ করে প্রচুর বিতর্কের জন্ম দেন ময়মনসিংহে জন্ম নেয়া তসলিমা নাসরিন। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও সমানভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হন এই লেখিকা। তার অনেক বই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয় যা তাকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত করে তোলে। আসুন, তার নিষিদ্ধ হওয়া ৬টি তুমুল জনপ্রিয় বই সম্পর্কে জানা যাক-
৪. লজ্জ্বা – উপন্যাস
- লেখক: তসলিমা নাসরিন
- প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- প্রকাশকাল: ১৯৯৩
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ১৯৯৩
বাংলাদেশের সর্বাধিক বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জ্বা’ উপন্যাসটি নারীবাদের উপর সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত বই। বাংলাদেশের নিষিদ্ধ বই হিসেবে এটি হয়তো অনেকেই পড়েছেন। ভারতের বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা এই নারীবাদী উপন্যাসটি প্রকাশনার ৬ মাসের মাথায় ইসলামী ভাবমূর্তি ভঙ্গের অপরাধে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কিন্তু, নিষিদ্ধ হওয়ার আগের ৬ মাসের ভেতর বইটির ৫০ হাজার কপি বিক্রি হয়ে যায় যা বইটির তুমুল জনপ্রিয়তার প্রমাণ।
পুরুষকে পশ্চাতে ফেলে নারীর শরীর নিয়ে খোলামেলাভাবে নারীর হাতেই লেখা এই উপন্যাসটি তসলিমা নাসরিনকে একদিকে যেমন নন্দিত করে তোলে একটা শ্রেণীর কাছে, অন্যদিকে অন্য আরেক গোষ্ঠীর কাছে করে তোলে নিন্দিত। আর এই নিন্দার ঝড়েই মূলত ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশেও বইটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এতে করে বইটি বন্ধ হয়ে যায়নি, বরং আরো বেশি করে বেরিয়ে আসে পাঠকদের সামনে। শুনতে আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, লজ্জ্বা সংগ্রহের দায়ে গ্রেফতার করা হয় এস এম ইউনুস আলী নামের একজন অধ্যক্ষকে।
বাংলা ভাষায় নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও বইটি হু হু করে প্রকাশিত হতে পৃথিবীর নানা ভাষায়। হিন্দি, উর্দু, উড়িষ্যা, গুজরাটিসহ ভারতের প্রায় সব আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি বইটি ইংরেজী, স্পেনিশ, ফার্সী ও ফ্রেঞ্চসহ আরো অনেক ভাষায় প্রকাশিত হয় যা তসলিমা নাসরিনকে বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত করে তোলে।
৫. সেই সব অন্ধকার – আত্মজীবনী
- লেখক: তসলিমা নাসরিন
- প্রকাশক: বাতিঘর প্রকাশনী
- প্রকাশকাল: ২০০৪
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২০০৪
নিজের আত্মজীবনী নিয়ে লেখা তসলিমা নাসরিনের ‘সেই সব অন্ধকার’ বইটি ইসলামের ধর্মের অবমাননা এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স:)-কে নিয়ে কূটক্তি করার কারণে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
৬. আমার মেয়েবেলা – আত্মজীবনী
- লেখক: তসলিমা নাসরিন
- প্রকাশক: —-
- প্রকাশকাল: ১৯৯৯
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ১৯৯৯
‘আমার মেয়েবেলা’ তসলিমা নাসরিনের প্রথম আত্মজীবনীমূলক গল্প গ্রন্থ যেখানে লেখিকা তার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। বইটি যে বছর প্রথম প্রকাশ পায়, ঠিক সে বছরই অশ্লীলতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাতের অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারের কৃতক নিষিদ্ধ হয়ে যায়।
লেখিকা মেয়েবেলায় মূলত যেসব যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, সেসব নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন যাতে অশ্লীলতার ছোঁয়া রয়েছে। প্রকৃত পক্ষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এটি একটি শাণিত প্রতিবাদ ছিল যা তখনকার পুরুষ সমাজের মুখোশ খুলে দিয়েছিল
৭. উতল হাওয়া – আত্মজীবনী
- লেখক: তসলিমা নাসরিন
- প্রকাশক: চারদিক
- প্রকাশকাল: জানুয়ারী, ২০০৩
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: আগষ্ট, ২০০২
কোলকাতার পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত প্রকাশনী পিপলস্ বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়, উতল হাওয়া যা মূলত তসলিমা নাসরিনের আরেকটি আত্মজীবনী, আমার মেয়েবেলার দ্বিতীয় পার্ট।
এ বইটিও নিষিদ্ধ করা ইসলাম বিরোধী অপপ্রচার, ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপনার জন্যে। ধর্মীয় সম্প্রীতিতে আঘাত হানার আশংকা থেকেই বাংলাদেশ সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করে।
৮. ক – আত্মজীবনী
- লেখক: তাসলিমা নাসরিন
- প্রকাশনা: বাংলাদেশ ও ভারত
- প্রকাশকাল: ২০০৩
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২০০৩
তসলিমা নাসরিনের জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় যেখানে কথা বলাকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘ক’ বলা হয়। আর এই কথা বলার আঞ্চলিক রূপটিই এই বইয়ের শিরোনাম হিসেবে উঠে এসেছে যেখানে লেখিকা কথা বলেছেন তার জীবনের নানা রকম না বলা কথা নিয়ে। আর এসব কথায় উঠে এসেছে এমন অনেক অজানা কথা যা উন্মোচিত করেছে দেশের অনেক প্রথিতযশা লেখকদের নোংরামি ও নারী উৎপীড়ণ।
‘ক’ বইটির বেশির ভাগ উৎপীড়ণের কথা মূলত বাংলাদেশের সাহিত্য-অঙ্গনের। যারফলে, এটি সাহিত্য জগতে তুমুল আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দেয়। বিশেষ করে, সৈয়দ শামসুল হকের মতো একজন প্রথিতযশা কবি ও লেখক এবং উপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনকে নিয়ে লেখিকার নিজের জীবনের সঙ্গে জড়ানো এমন অনেক কথা উঠে এসেছে যা তখনকার পাঠক সমাজকে বিস্মৃত করেছে।
তবে, এই দুইজন বিখ্যাত লেখক ছাড়াও যাদের বিরুদ্ধেই তিনি ‘ক’ গন্থে কলম ধরেছেন, তাদের প্রায় সকলেই তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে তাদের যৌন নিপীড়নের কথা অস্বীকার করেছেন। এমনকি, সৈয়দ শামসুল হক লেখার বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। মূলত, তার মামলার উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ সরকার ‘ক’ বইটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। আর বাংলাদেশের নিষিদ্ধ বই এর তালিকা করলে তাতে এটি অন্য অনেক বইয়ের উপরেই থাকার কথা।
৯. দ্বিখণ্ডিত – আত্মজীবনী
- লেখক: তাসলিমা নাসরিন
- প্রকাশক: ইস্টিশন
- প্রকাশকাল: ২০০৩
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২০০৩
‘দ্বিখন্ডিত’ তসলিমা নাসরিনের ‘ক’ এর নতুন সংস্করণ। বাংলাদেশে ‘ক’ নিষিদ্ধ হওয়ার পর এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ‘দ্বিখন্ডিত’ নামে নতুন করে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পশ্চমবঙ্গের সরকারও এটি নিষিদ্ধ করে। কারণ হিসেবে দেখানো হয় ইসলাম ধর্মের অবমাননা।
১০. নারী – নারীবাদী রচনা
- লেখক: হুমায়ুন আজাদ
- প্রকাশক: নদী প্রকাশনী ও আগামী প্রকাশনী
- প্রকাশকাল: ১৯৯২
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ১৯ নভেম্বর ১৯৯৫
- নিষিদ্ধের আদেশ বাতিল: ৭ মার্চ ২০০০
হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থটি বাংলাদেশের প্রথম নারীবাদী বই হিসেবে ব্যাপক আলোচনায় আসে। বইটি প্রথমবার প্রকাশ করে নদী প্রকাশনী, প্রকাশের পরই বইটির পুরূষ এবং নারী উভয়ের কাছে যেমন সমাদৃত হয়, তেমনই হয় বিতর্কিত। এরপর, বইটি আবার বের করে আগামী প্রকাশনী। ফলে, বইটির প্রচার-প্রসার আরো বেড়ে যায়।
১৯৯২ সালের বাংলা একাডেমী তথা একুশে বই মেলায় প্রকাশিত হলেও বইটি ১৯৯৫ সালের ১৯ শে নভেম্বর তৎকালীন জোট সরকার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র শাসনামলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। নারীবাদ নিয়ে ২১টি রচনাপঞ্জির সমন্বয়ে ৪০৮ পৃষ্ঠার এ বইটি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়।
মজার বিষয় হচ্ছে মুসলমানদের ‘মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী’ লেখার কারণে নিষিদ্ধ করার যে আদেশ জারী করা হয়, তাতে যিনি স্বাক্ষর করেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন নারী। যাইহোক, ২০০০ সালের ৭ মার্চ হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ গ্রন্থের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
১১. আমার ফাঁসি চাই – ইতিহাস গ্রন্থ
- লেখক: মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান
- প্রকাশক: স্বর্ণলতা ও বনলতা প্রকাশনা
- প্রকাশকাল: ১৯৯৯
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ১৯৯৬
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিবহত্যা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মতিয়ুর রহমানের আত্মজীবনি ও সমালোচনামূলক ইতিহাস নির্ভর বই ‘আমার ফাঁসি চাই’। বইটি প্রকাশনার পর পরই পুরোপুরি আলোচনায় চলে আসে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে বইটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। কারণ, বইটি মুক্তিযুদ্ধের ভেতরকার কিছু গোপণ বিষয়ের আলোচনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনায় ভরপুর।
লেখক বইটিতে শুধু নিজের সমালোচনাই করেননি, আরো দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। মজার বিষয় হচ্ছে, ‘আমার ফাঁসি চাই’ বইটির লেখক মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ুর রহমান বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারি ছিলেন। আর বইটি নিষিদ্ধ করেছে আওয়ামী লীগ সরকারই।
কাজী নজরুল ইসলামের নিষিদ্ধ ৫ বই
কবি, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ কাজী নজরুল ইসলামের কলম সবসময় স্রোতের বিপরীতে চলেছে। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিদ্রোহী কবি ও লেখক হিসেবে তিনি সর্ব মহলের মানুষের কাছে সমাদৃত ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবির খেতাবটি তাই তার নামের সাথেই যুক্ত হয়েছে। কিন্তু, জাতীয় কবি হওয়া সত্ত্বেও সরকার কর্তৃক তাঁর কয়েকটি বই নিষিদ্ধ হয়েছে। আসুন, বাংলার বাগিচার বুলবুল সেই কাজী নজরুলের নিষিদ্ধ বইগুলো সম্পর্কে জানা যাক।
১২. যুগবাণী – প্রবন্ধ গ্রন্থ
- লেখক: কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশক: …
- প্রকাশকাল: ২৫ অক্টোবর ১৯২৬
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২৩ নভেম্বর ১৯২৬
ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর নিজেদের স্বাধীনতার দাবীতে সারা দেশে যখন অসহযোগ আন্দোলন তুঙ্গে তখন কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ গ্রন্থ যুগবাণী প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে যে প্রবন্ধগুলো সংলকলন করা হয় সেগুলোর বেশিরভাগই কাজী নজরুল সম্পাদিত ‘নবযুগ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
যুগবাণীতে কাজী নজরুলের বিদ্রোহী মনোভাব, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আকাঙ্খা, ভূখানাঙ্গা মানুষের আর্তনাদসহ আরো অনেক কিছু ফুটে উঠেছে বিভিন্ন প্রবন্ধে।
প্রবন্ধগুলোর বেশিরভাগই ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও স্বাধীনতাকামী মানুষের মনোভাব আর সাধারণ মানুষের মুক্তির দাবী নিয়ে রচিত। ফলশ্রুতিতে, উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচার, প্রসার, ব্রিটিশ বিদ্রোহ এবং দেশদ্রোহীতার অভিযোগ তুলে তৎকালীণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ফৌজদারি বিধির ৯৯- নীতিমালা অনুসারে বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৩. বিশের বাঁশী – কাব্যগ্রন্থ
- লেখক: কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী
- প্রকাশকাল: ১৯২৪
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ২২ অক্টোবর ১৯২৪
ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার নির্মূল আর সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে বিপুল ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ২৭টি কবিতা নিয়ে ৩৩ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। এই বইয়ের প্রায় সবগুলো কবিতাতেই কাজী নজরুল ইসলামের বিল্পবী অনুভূতি ও বিদ্রোহের মনোভাব প্রকাশ পায়। ফলে, যুগবাণী’র ঠিক ২ বছর পরই রাষ্ট্র দ্রোহীতার অভিযোগে এই বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে শাসকশ্রেণী।
কবিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের আইন অমান্য করা, একই সাথে তৎকালীণ তরুণদের বিদ্রোহী করে তোলা এবং সর্বোপরি দেশ দ্রোহীতার অভিযোগ এনে একটি গেজেট ঘোষণার মাধ্যমে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।
১৪. দুর্দিনের যাত্রী – প্রবন্ধগ্রন্থ
- লেখক: কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশক: —
- প্রকাশকাল: ১৯২১
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ১৯২৪
ধূমকেতুতে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখা একাধিক সম্পাদকীয় একত্র করে ১৯২১ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দুর্দিনের যাত্রী’। ব্রিটিশ শাসন আমলকে মূলত দুর্দিন হিসেবে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আর এই দুর্দিনের যাত্রী হিসেবে তিনি বুঝিয়েছেন তৎকালীণ তরুণ প্রজন্মকে।
তরুণদেরকে ব্রিটিশদের বিভিন্ন মিথ্যা ত্যাগ করে, পুরাতন সব ধ্যান-ধারণাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে নব সৃষ্টির সাধনায় মগ্ন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন কবি। আর এই তরুণদেরকে উস্কাণীর অভিযোগেই নিষিদ্ধ করা হয় দুর্দিনের যাত্রী।
১৫. প্রলয় শিখা – কাব্যগ্রন্থ
- লেখক: কাজী নজরুল ইসলাম
- প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী
- প্রকাশকাল: ১৯৩০
- নিষিদ্ধ ঘোষিত: ১৯৩১
‘প্রলয় শিখা’ প্রকাশের পর পরই ভারত ও বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে যেমন প্রলয়ের আগুন জ্বলতে শুরু করে, একই সাথে সরকারের রোষানলে পড়ে যায় কাব্যগ্রন্থটি। কারণ, এই কাব্যগ্রন্থেও কবির বিদ্রোহী আত্মার পরিষ্ফুটন ঘটে যা তৎকালীণ যুব সমাজকে সরকারের বিরুদ্ধে প্রলয় ঘটানোর প্ররোচনা দেয়।
ফলে, রায়বাহাদুর তারকনাথ সাধু নামের তখনকার একজন পাবলিক প্রসিকিউটর বইটি বাজেয়াপ্ত করার জন্যে পুলিশের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে অনুরোধ করে। আর তার অনুরোধ আমলে নিয়েই মূলত তৎকালীণ সরকার প্রলয় শিখা প্রজ্জ্বলিত হওয়ার পথে নিষেধাজ্ঞা জারী করে।
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ বই সম্পর্কে আপনার হয়তো একটা ভাল ধারণা হয়েছে। এই ১৫টি বইয়ের বাইরেও আরো কিছু নিষিদ্ধ বই রয়েছে যেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্য নয় বলে আমরা সেগুলো নিয়ে লেখাটি বড় করতে চাইনি।
হতে পারে যে, এখানকার ১৫টি বইয়ের সবগুলোই আপনার পড়া হয়ে গেছে। কিংবা, কয়েকটি পড়েছেন। যেগুলো পড়েননি, নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে সেগুলো পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়ে গিয়েছে। নেটে সার্চ দিলেই আপনি হয়তো বইগুলোর পিডিএফ কপি পেয়ে যাবেন। আমরা লিংক দিতে পারতাম, কিন্তু দেইনি এই কারণে যে, এটা আইনসন্মত নয়। তাই, যে লিংক দেবো, সেটি কিছুদিন পর না’ও থাকতে পারে।
Leave a Reply