সারা বছর আমরা বিভিন্ন পণ্য কিনে থাকলেও একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে যখন সেই পণ্যের চাহিদাটা একটু বেশি বেড়ে যায়। এমন পণ্য যেগুলো সম্পূর্ন সংসার জীবনে হয়তো একবার কিনলেই হয়ে যায়। এ-রকম একটি প্রয়োজনীয় পণ্য হচ্ছে ফ্রিজ। সুতরাং, ফ্রিজ কেনার আগে অবশ্যই আপনাকে বিশেষ কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে।
যেহেতু, এই হোম অ্যাপ্লায়েন্সটি বারবার কেনা হয় না এবং এর পেছনে যথেষ্ট্য অর্থ ব্যয়, সেহেতু এটি অবশ্যই আমাদের একটু বিচার-বিবেচনা করে দেখেশুনে কেনা উচিত।
আসছে কোরবানির ঈদ, যেখানে সবকিছুর মাঝে আমাদের আরেকটি চিন্তা থাকে কোরবানির গোসত কিভাবে সংরক্ষণ করা যায়। ঈদের আগে আগে ঠিক এই সময়টা ধুম পড়ে যায় ফ্রিজ কেনার। এই সুযোগে ফ্রিজ কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের উপর নিয়ে আসে আকর্ষণীয় সব অফার যা আমাদের চাহিদাকে করে আরও লোভনীয়।
কিন্তু এতো শত অফারের ভীড়ে আপনি সঠিক ফ্রিজটি কিনছেন তো!
ফ্রিজ এমন একটি পণ্য যেটি আমরা ইচ্ছা করলেই প্রতিদিন কিনতে পারি না। আবার দুইদিন পর পর পরিবর্তন করারও তেমন সুযোগ নেই। তাই, এই জাতীয় পণ্য কেনার সময় একটু সচেতন না হলে কি হয়! যাচাই-বাছাই করে বাজারের শত-শত ফ্রিজের ভীড়ে আপনার জন্য সঠিক ফ্রিজটি নির্ধারণ করার জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিন।
ফ্রিজ কেনার আগে বিবেচ্য বিষয়
এখানে এমন ১২টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে যেগুলো বিবেচনায় রাখলে ফ্রিজ কিনে আপনি কখনোই ঠকবেন না। একই সাথে, ফ্রিজ কেনার সময় যে ভুলগুলো করা থেকে বিরত থাকতে হবে, সেগুলো নিয়েও কিছুটা টাচ্ দেয়া হয়েছে।
বাজেট নির্ধারণ থেকে বিরত থাকুন
যেহেতু এটি আমাদের প্রতিদিনের পণ্য নয়, তাই আপনি কত বাজেটের মধ্যে কিনতে চান, সেটি আগে ঠিক করে নিন। তবে, বাজেট একেবারে নির্ধারণ না করাই উত্তম। কারণ, এতে পরিসর ও কোয়ালিটির মতো বিষয়গুলো কম্প্রোমাইজড করা লাগতে পারে।
তাই, বাজেট নির্দিষ্ট না হয়ে একটা রেঞ্জের মধ্যে হওয়া উচিৎ। যেমন, আপনি বাজেট করতে পারেন এভাবে-
- ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে।
- ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার হাজার টাকার মধ্যে।
- ৫০ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকার মধ্যে।
এটা জাস্ট আপনার আইডিয়ার জন্যে বললাম। তবে, আপনার যদি বর্তমানে এমন অবস্থা হয় যে ফ্রিজ দরকার খুবই, কিন্তু বাজেট ৩০ হাজারেরও কম, তাহলে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার ভেতর ১০টি ভাল মানের ফ্রিজ থেকে যাছাই-বাছাই করে যে কোনটি কিনতে পারেন।
তবে, আমার আরেকটা পরামর্শ থাকবে। তার আগে বলে নেই যে আপনার অবস্থা যাই হোক, অবশ্যই আপনি প্রতি বছর ফ্রিজ পরিবর্তন করতে চাইবেন না! অথবা, ফ্রিজ কিনে তার পেছনে মেরামতের জন্য বিশাল অংকের টাকা চলে যাক এইটাও আপনার কাম্য নয়। তাই, একটি জিনিস যেহেতু কিনবেন একটু দাম দিয়ে ভালো পণ্যই ঘরে নিয়ে আসুন।
পরিসর ঠিক করে নিন।
আপনি যেই ফ্রিজটি কিনতে চাচ্ছেন, সেটি হয়তো আপনার সামর্থ্যের মাঝে ঠিক হয়ে গিয়েছে। কেনার পর দেখলেন-
- ফ্রিজটি আপনার রান্নাঘরের জন্য ফিট হচ্ছে না।
- অন্যান্য আসবাবের কারণে বা রুমের লে-আউটের কারণে ফিট হচ্ছে না ড্রইংরুমের জন্যেও।
- কিংবা যেই জায়গাটায় আপনি ফ্রিজ রাখতে চাইছেন, তার তুলনায় ফ্রিজটি বড় আকৃতির হয়ে গিয়েছে।
- অথবা, আপনার নির্ধারিত জায়গার চেয় ফ্রিজটি অনেক ছোট হয়ে গিয়েছে।
এক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই জায়গা মেপে নেওয়া উচিত। এমনভাবে পরিমাপ করবেন, যাতে দেওয়াল থেকে কয়েক মিটার দূরে অবস্থান করে যা আপনার ফ্রিজের পিছনের পরিষ্কার করতে সুবিধা হবে। একই সাথে, সামনে ফ্রিজের দরজা খুব সহজে খোলা ও বন্ধ করা যায় সে বিষয়টি লক্ষ্য রাখবেন।
এমন অনেক বাড়ি আছে যাদের সিলিং অনেক নিচু সেক্ষেত্রে অবশ্যই উচ্চতা পরিমাপ করা প্রয়োজন। বাজারে এখন বিভিন্ন উচ্চতা ও বিশালাকৃতির ফ্রিজ পাওয়া যায়। তাই, ফ্রিজ কেনার আগে জায়গা পরিমাপ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
শুধুমাত্র ব্র্যান্ডের নামের ওপর নির্ভর করে ফ্রিজ কিনবেন না
বাজারে যেমন তেমন ফ্রিজ দেখা যায় অনেক। বাহারি রঙ এবং আকর্ষণীয় অফারে ক্রেতাকে নিজের ফাঁদে ফেলতে অনেকগুলো ছোট ছোট দোকান বসে থাকে। কিন্তু আপনাকে অবশ্যই এই বিষয়গুলোতে লক্ষ্য রাখতে হবে যেন আপনি একটি ভাল ব্র্যান্ডের ফ্রিজ কিনতে পারেন। ব্যান্ড নির্বাচন যেমন আপনার সময় বাঁচাবে, তেমনই ভালো পণ্য ও নিশ্চিত করতে পারে।
ফ্রিজের জন্যে কয়েকটি নামকরা ব্র্যান্ড হচ্ছে-
- LG Refrigerator
- Whirlpool Refrigerator
- Samsung Refrigerator
- Singer Refrigerator
- Walton Refrigerator
- Haier Refrigerator
- Toshiba Refrigerator
- Sharp Refrigerator
- Mitsubishi Refrigerator
- Panasonic Refrigerator
তবে অবশ্যই শুধু নাম ডাকে ভুললে হবে না, লক্ষ্য রাখতে হবে ফ্রিজের মানের অপর। হ্যাঁ যদি আপনি ফ্রিজটির সম্পর্কে বিস্তারিত না জেনে শুধু ব্র্যান্ডের নামের ওপর নির্ভর করে ফ্রিজটি কিনে ফেলেন, তবে পরবর্তী ভোগান্তির জন্য কিন্তু আপনেই দায়ী থাকবেন।
তাই, বাহিরের যেমন তেমন ফ্রিজ যেমন কিনবেন না, ঠিক তেমনই চোখ বন্ধ করে শুধু মাত্র ব্র্যান্ডের নামের ওপর নির্ভর করেও ফ্রিজ কিনবেন না। কয়েকটি কোম্পানির ফ্রিজের সাথে তুলনা করে আপনার জন্য সঠিক ফ্রিজটি বেছে নিন।
ওয়ারেন্টি এবং গ্যারান্টির বিষয়ে লক্ষ্য রাখুন
যেহেতু ফ্রিজ আপনি প্রতিনিয়ত কিনবেন না, তাহলে অবশ্যই তার স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখা আপনার গুরু দায়িত্ব। ইলেট্রোনিক্স জিনিস যে-কোনো সময় যান্ত্রিক ত্রুটির সন্মুখীন হতে পারে। তখন সার্ভিস দিতে দিতে দেউলিয়া হবার উপক্রম হতে পারে। যে জিনিষে দামের চেয়ে সার্ভিস চার্জ বেশি পড়ে যায়, সে জিনিসে আর লাভ কোথায়!
এই কারণে যখন ফ্রিজ কিনবেন, ম্যানুফ্যাচার কোম্পানীর গ্যারান্টি-ওয়ারেন্টি আছে কি না তা জেনে নিন। তবে, তার আগে আপনাকে অবশ্যই আপনাকে গ্যারান্টি ও ওয়ারেন্টির মধ্যে পার্থক্য জানতে হবে। আশা করি, জেনেছেন। এবার , যে ব্র্যান্ডের ফ্রিজ কিনবেন সেই ব্যান্ডের গ্যারান্টি কতদিন দিচ্ছে এবং তাদের সার্ভিসিং ওয়ারেন্টটি কত দিনের এগুলো আগে থেকে শিওর হয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
গ্যারান্টি ও ওয়ারেন্টির বিষয়ে যে দিকগুলো খেয়াল করবেন-
- সব সময় গ্যারান্টি ও ওয়ারেন্টির ব্যাপারে টার্মস্ এন্ড কন্ডিশনগুলো পড়ে নেবেন।
- জেনে নিন কোন কোন ক্ষেত্রে গ্যারান্টি আর কোন কোন অবস্থায় ওয়ারেন্টি প্রযোজ্য হবে।
- ওয়ারেন্টির ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো কাভার করবে, সেটা জেনে নিন। যেমন, সব পার্টস্ এর ক্ষেত্রেই ওয়ারেন্টি থাকবে নাকি কিছু কিছু পার্টসের ক্ষেত্রে ওয়ারেন্টি প্রযোজ্য হবে।
- যান্ত্রিক সমস্যার ক্ষেত্রে কোম্পানী থেকে যিনি ঠিক করতে আসবেন, তার পারিশ্রমিক কী কোম্পানী বহন করবে, নাকি আপনাকে বহন করতে হবে।
ডিজাইনের প্রতি লক্ষ্য রাখুন
বর্তমান বাজারে হরেক ডিজাইনের ফ্রিজ পাওয়া যায়। ডিপ ফ্রিজ বা নানা সাইজের রেফ্রিজেটর তো আছেই। এছাড়াও সিঙ্গেল দরজা, ডাবল দরজা। ড্রয়ার সিস্টেম। এমন নানা রকম ডিজাইন দিয়ে ভরপুর। এতো শত ডিজাইনের ভীড়ে আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য উপযুক্ত ফ্রিজটি খুঁজে নিন।
ডিজাইনের দিক থেকে বাজারে যে ধরণের ফ্রিজ রয়েছে-
- Top-freezer refrigerators
- Bottom-freezer refrigerators
- Side-by-side refrigerators
- French-door refrigerators
চটজলদিতে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিবেন না যার কারণে পরবর্তীতে আপসোস করতে হয়। ‘হয়তো ওইটি নিতে পারতাম! না, ফ্রিজের সাইজটা আর একটু বড় হলে ভালো হতো! এমন অভিযোগ আর আপসোস হওয়ার সুযোগ না দিয়ে ফ্রিজ কেনার আগে ভেবে নিন কোনটি আপনার প্রয়োজন।
শব্দযুক্ত যান্ত্রিক ত্রুটি গুলো থেকে বিরত থাকুন
সাধারণত সস্তা এবং সিস্টেমের সমস্যা আছে এমন ফ্রিজগুলোতে Heat-exchanging pipes কিংবা compressor এর মাঝে যান্ত্রিক ত্রুটি থাকার কারণে শব্দ করে। অবশ্যই ফ্রিজ কেনার সময় এই বিষয়টি মনে রাখা উচিত। কম্প্রেসর যদি ভালো মানের না হয়, ফ্রিজের ঠাণ্ডা করার ক্ষমতা যেমন কমতে থাকে তেমনি আয়ু ও কমে যায়।
সাধারণত ফ্রিজ থেকে দুই ধরণের সাউন্ড হয়-
- নরমাল সাউন্ড – যা স্বাভাবিক এবং সহনীয়
- অ্যাব-নরমাল সাউন্ড – অস্বাভাবিক ও অসহনীয়
বৈদ্যুতিক খরচ কেমন হবে!
ফ্রিজ কেনার সময় যেই বিষয়টি কোনভাবেই এড়ানো যাবে না তা হল এই ফ্রিজ থেকে বাসার বিদ্যুৎ বিল কত বেড়ে যাবে। অনেকের এমন অভিযোগ থাকে ফ্রিজের কারণে প্রতিমাসে বিদ্যুৎ বিলে হাজার টাকা সংযুক্ত হচ্ছে। অ-স্বাভাবিক কিছু না।
এমন অনেক ফ্রিজ আছে যার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী বিদ্যুৎ অনেক বেশি খরচ হয় যার কারণে বিদ্যুতের বিলও বেশি আসে। সে কারণে ফ্রিজ কেনার আগে আমাদের ফ্রিজের বিদ্যুতের খরচের বিষয়টি নিয়ে জেনে শুনে কেনা উচিত।
সাধারণত কোন ফ্রিজ মাসিক কতটা বিদ্যুৎ খরচ করে দেখে নিন-
- ১০০ থেকে ১৯৯ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফ্রিজ – ২৮ থেকে ৩০ কিলোওয়াটস্
- ২০০ থেকে ২৯৯ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফ্রিজ – ৩৫ থেকে ৪০ কিলোওয়াটস্
- ৩০০ থেকে ৩৯৯ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফ্রিজ – ৪০ থেকে ৫০ কিলোওয়াটস্
- ৪০০ থেকে ৪৯৯ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফ্রিজ – ৪৫ থেকে ৫৫ কিলোওয়াটস্
- ৫০০ থেকে ৫৯৯ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ফ্রিজ – ৬০ থেকে ৭০ কিলোওয়াটস্
ফ্রিজের ফিচারগুলো দেখে নিন
একটা ফ্রিজে কী কী যন্ত্রপাতি আছে, সেটি কী কী সুবিধা প্রদান করছে, ইত্যাদি হচ্ছে ফ্রিজের ফিচার। ফ্রিজ কেনার সময় আপনাকে অবশ্যই ফিচারগুলো দেখে নিতে হবে। যা যা দেখবেন-
- ফ্রিজের ভেতরের তাকগুলো ভাল করে দেখে নিন।
- অ্যাডজাস্টেবল তাকগুলোর দিকেও নজর দিন।
- ড্রয়ারগুলো ভাল করে চেক করুন।
- টেম্পারেচার ও টেম্পারেচার কন্ট্রোলিং ফিচার দেখে নিন।
মেরামত খরচ
আগেই বলে নিয়েছি কোম্পানির ওয়ারেন্টি প্রধান লক্ষণীয় বিষয়গুলোর একটি। আপনি অবশ্যই খুব দাম দিয়ে একটা জিনিস কিনে সেটি প্রতি মাসে মেরামত করতে চাইবেন না! কোম্পানিগুলোর মাঝে মাঝে তাদের ওয়ারেন্টি সাথে মেরামতের পুরো খরচটা বহন করে। কোন ব্যান্ড কেমন সার্ভিস দেয় এটি অবশ্যই নজরে রাখতে হবে।
যদি মেরামত খরচ নিজেকে বহন করতে হয়, তবে কেমন খরচ হতে পারে একটা আইডিয়া নিয়ে রাখার চেষ্টা করুন।
শেষ কথা
পরিশেষে একটি কথা বলা যায়, শুধু ফ্রিজ কেনার আগে নয়, বরং যে কোন পণ্য কেনার সময়ই আমাদের কিছু বিষয় মনে রাখা উচিত এতে করে আমাদের টাকার যথার্থ ব্যবহার করা সম্ভব।
কোন গুনগত পণ্যের মান যেমন নিশ্চিত করা আমাদের জন্য আবশ্যক, ঠিক তেমনি টেকসই মজবুত বিষয়টি ও দেখতে হয়। তার পাশাপাশি বাজার চাহিদা অনুযায়ী একই রকম পণ্যগুলোর মাঝে আমাদের তুলনা করে সেরাটি নির্বাচন করা বুদ্ধিমানের কাজ। যাই হোক, উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে আপনার জন্য সেরা ফ্রিজটি ঘরে নিয়ে আসুন।
Leave a Reply