বাচ্চাদেরকে পড়াশুনায় মনোযোগী করার কৌশল আছে অনেক, এটি খুব একটা কঠিন কাজ নয়। বাচ্চারা পড়াশুনার চেয়ে খেলাধুলায় বেশি মনোযোগী হবে, দুষ্টুমিতে মেতে থাকবে, বেশি কিছু বললে মন খারাপ করে ফেলবে, খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দেবে; এগুলো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে তাদেরকে পড়াশুনায় মনোযোগী করা যাবে না এমন নয়!
চাইলেই আপনি কিছু কৌশল অবলম্বন করে আপনার সন্তানকে পড়াশুনায় আগ্রহী করে তুলতে পারেন।
প্রত্যেক পিতামাতাই তার সন্তানের ভালো পড়াশুনা নিয়ে চিন্তিত। বাবা-মা হিসাবে, আমরা বাচ্চাদের জন্য ভাল পড়াশুনা চাই, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সন্তানকে পড়াশুনায় আগ্রহী করে তোলার জন্যে পিতামাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল শেখার প্রক্রিয়াটিকে সহজ এবং দক্ষ করে তোলা। কেবল সঠিক অনুপ্রেরণা দিয়ে এটি সম্ভব হতে পারে।
অনুপ্রেরণার সঠিক পদ্ধতি বাচ্চাদের শিখতে সহায়তা করে। আপনার সন্তানকে শেখার জন্য কীভাবে প্ররোচিত করবেন সে সম্পর্কে ১০টি দূর্দান্ত কৌশল নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।
বাচ্চাদেরকে পড়াশুনায় মনোযোগী করার কৌশল
এখনকার বাচ্চাদের পড়াশুনায় মনোযোগী না হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে স্মার্টফোন। অধিকাংশ বাচ্চার বেশিরভাগ সময় কাটে স্মার্টফোনে গেম খেলে। কাজেই, আগে আপনার সন্তানকে গেম খেলা থেকে বিরত রাখার ৪টি সুপার উপায় জেনে নিন। এরপর, পরবর্তী ধাপে যান।
১। পড়ার পরিবেশ তৈরি করুন
আমাদের সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, মানুষ পরিবেশের দাস। পরিবেশ মানুষকে ভালো কিংবা মন্দ কাজ করতে বাধ্য করে। শিশুরাও তার বাহিরে নয়। কিছু শিশু এমন যারা শান্ত পরিবেশ ভালোবাসে। আবার, কিছু শিশু যে-কোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
আপনার শিশু কোন ধরণের পরিবেশে পড়াশোনা করতে পছন্দ করে তা বোঝা এবং সেই পরিবেশ তৈরি করা আপনার প্রথম পদক্ষেপ। আপনার ঘরের টেলিভিশন, আইপ্যাড, সেল ফোন ইত্যাদি সমস্ত ডিভাইসের সংস্পর্শ এড়াতে সুইচ অফ করা বা আলাদা ঘরে রাখা দরকার। আপনার যদি পড়াশুনার জন্য কম্পিউটার ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়, তবে নিশ্চিত হয়ে নিন যে এটি কেবল পড়াশুনার জন্য ব্যবহৃত হয় ।
প্রয়োজনীয় উপাদান- আপনার শিশুর প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু হাতের কাছে রাখুন যাতে আপনার সন্তানের কিছু পাওয়ার জন্য উঠার দরকার না হয়। সমস্ত হোমওয়ার্কের বই, খাতা, পেনসিল এমনকি টেবিলে পানির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এই সমস্ত কৌশল বাচ্চাদের দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করতে এবং মনোযোগ বাড়াতে সহায়তা করে!
২। মাঝে মাঝে পুরষ্কার দিন
ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, তাদের বিভিন্ন খাবার দিয়ে উৎসাহ করা এটি অনেকটাই কাজে আসে। এমনকি, তাদের ব্যবহারে প্রভাবিত হয় যা তাদের যে কোন কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিন যে, তারা সময়মতো হোমওয়ার্ক করলে চকোলেট বা কোনও বিশেষ খাবার পুরষ্কার পাবে।
তবে এই পদ্ধতির দীর্ঘমেয়াদের জন্য ভাল নয়। কারণ, তারা এগুলি পেয়ে অব্যস্থ হয়ে যাবে। অথবা, বিভিন্ন সময় তাদের বন্ধুদের বাড়িতে, ওয়াটার পার্কে, তাদের প্রিয় আইসক্রিমের দোকানে বা আধা ঘন্টা অতিরিক্ত কার্টুনের সময় নেওয়া থেকে অনেকটা কাজে আসতে পারে। এটি সর্বদা তাদের পড়াশুনার সময়কে প্রত্যাশিত করে তুলবে এবং পড়াশুনায় মনোযোগী করার কৌশল হিসেবে দারুণ ভূমিকা পালন করবে।
যেন ঘুষ না হয়ে যায়- খেয়াল করুন আপনার পুরস্কারের ঘোষণা যেন ঘুষের পর্যায়ে না চলে যায়। এমন যেন না হয়ে যায় যে, আপনার সন্তান এমন অভ্যস্ত্য হয়ে যায় যায় যে কোন না কোন কিছু পাবার প্রতিশ্রুতি না পেলে সে আর পড়তে চায় না। এটা তাকে ভবিষ্যতে ঘুষখোর অফিসার হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। অর্থাৎ, তার মনোজগতে এমন ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যেতে পারে যে, কিছু না পেলে কিছু করবো না।
৩। তাদের প্রশংসা করুন
কে না চাই মানুষ তার প্রশংসা করুক। প্রশংসা মানুষের মনকে উদ্যমী করে তুলে শিশুদের ক্ষেত্রেও তার বাহিরে নয়। আপনার সন্তানের প্রতিটি সঠিক কাজের জন্য সর্বদা প্রশংসা করুন। এমনকি যদি এটি ভুল হয়, সন্তানের প্রশংসা করা আপনার চেষ্টা করা উচিত।
আপনার প্রশংসা বাচ্চাদের অনুপ্রাণিত করবে এবং তাদের মনে হবে যে সমস্যার সমাধান করা জীবনে প্রশংসিত করে তুলবে। এই কৌশলটি তাদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্ম-সম্মান বাড়িয়ে তুলবে।
সতর্কতা: তবে, অতি মাত্রায় প্রশংসা নয়। এতে বাচ্চা ওভার কনফিডেন্ট হয়ে যেতে পারে। ফলে, “আমি তো সব পারি” এ-রকম চিন্তা থেকে পড়াশুনায় গাফিলতি দিতে পারে।
৪। স্বাস্থ্যকর খাবার দিন
স্বাস্থ্যকর খাবারই প্রমাণ করে একটি শিশু কতোটা চটপটে কিংবা উদ্যমী। জাঙ্ক ফুড বা চিনি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া শিশুকে অলস করে তোলে। যখন বাদাম, ডিম এবং চর্বিযুক্ত মাংসের মতো প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো হয়, তখন তাদের মনে উৎফুল্লতা বাড়বে এবং তাদের দেহে শক্তি বাড়িয়ে তুলবে। শরীর সুস্থ্য থাকলে পড়াশুনাও ভালো হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, শাকসবজি এবং ফল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির সাহায্যে দেহকে ইনজেক্ট করে যার ফলস্বরূপ আপনার সন্তানের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ঘটে।
৫। সন্তানকে পড়াতে নিজেও পড়ুন
তাদের পড়াতে এবং শিখাতে আগ্রহী করার জন্য, আপনি প্রতিদিন তাদের কাছে পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন। পড়াগুলো তাদের গল্পের বই বা তাদের পাঠ্যপুস্তকের বই হতে পারে। আপনার পড়াশুনার সাথে সাথে সেও পড়তে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। এভাবে, আপনি আপনার সন্তানকে পড়াশুনাই মনোযোগী করে তুলতে পারেন।
অতিরিক্ত লাভ- সন্তানের জন্যে পড়তে গিয়ে আপনার নিজের পড়ার অভ্যাশ তৈরি হয়ে যাবে। প্রথম দিকে সন্তানের গল্পের বই পড়লেও ধীরে ধীরে আপনি অন্যান্য বই পড়ার দিকে ঝুঁকতে পারবেন। এতে করে আপনার বাংলা সাহিত্যের অনেক ভাল ভাল লেখকের বইগুলো পড়া হয়ে যাবে।
৬। তাদের প্রশ্নের উত্তর দিন
শিশুরা প্রশ্ন করে শিখতে ভালোবাসে। তাই, তাদের ঘন ঘন প্রশ্ন বিরক্ত মনে করে এড়িয়ে যাবেন না। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে বা উত্তর দিতে লজ্জা বোধ করবেন না। কারণ, কোন প্রশ্নই অবহেলিত প্রশ্ন নয়। তারা জীবনের এমন একটি পর্যায়ে যেখানে সবকিছু নতুন এবং অপ্রতিরোধ্য। তাই, আপনাকে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তাদের কৌতূহল মেটাতে হবে। এটিও সন্তানকে পড়াশুনায় মনোযোগী করার কৌশল হিসেবে দারুণ কাজে দেবে।
বাড়তি পরামর্শ- আপনার সন্তানের আকস্মিক কোনও প্রশ্নের উত্তর যদি আপনার জানা না থাকে, তবে গুগলে সার্চ করে জেনে নিন। আর আপনার সন্তান যদি একটু বড় হয়, যদি নেট ব্যবহার করা শিখে থাকে, তবে তাকেই বলুন গুগলে সার্চ করে দেখে নিতে। কিভাবে গুগলে সার্চ করতে হয়, সেটা প্রথমদিকে তাকে শিখিয়ে দিন।
৭। রুটিন তৈরি করুন
কথায় আছে পরিকল্পনা কাজের অর্ধেক। পরিকল্পনা করে একটি রুটিন তৈরি করুন, রুটিনের মাধ্যমে আপনার বাচ্চাকে সময়ের মূল্য দিতে শিক্ষা দিন।
আপনার বাচ্চা সারাদিন কোন কোন সময় পড়বে এবং কখন কখন খেলবে বা টিভি দেখবে, তা রুটিন মাফিক করে তুলুন। তার সময়কে যদি বেঁধে দিতে পারেন এবং সে অনুযায়ী তাকে অভ্যস্থ্য করে তুলতে পারেন, তবে সে পড়াশুনায় শুধু মনোযোগীই নয়, পরীক্ষাতেও অনেক ভাল রেজাল্ট করবে।
মনে রাখবেন, বাচ্চাকে রুটিন দিয়ে ছেড়ে দেয়া যাবে না। সে রুটিন ফলো করছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শুরুর দিকে নিজেকেও বাচ্চার রুটিনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে হবে। অর্থাৎ, নিজেকে বাচ্চার রুটিনের সঙ্গে সময় দিতে হবে।
৮। সে কী শিখছে তার দিকে মনোনিবেশ করুন
স্কুল থেকে বাড়ি আসার সাথে সাথে আপনার সন্তানকে গণিত পরিক্ষা কেমন হয়েছে জিজ্ঞাসা করার পরিবর্তে তাকে আজকে গণিত কী শিখিয়েছে তা শিখিয়ে দিন। কি রেজাল্ট করেছে সে দিকে না তাকিয়ে কি শিখেছে তার দিকে নজর দিন। যেভাবে নজর দেবেন-
- আপনার সন্তানকে জানান যে পরীক্ষার গ্রেডের চেয়ে প্রকৃত পড়াশোনা আরও গুরুত্বপূর্ণ।
- কেবল ফলাফলই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, এটা মেনে নিন এবং তাকে মানিয়ে তুলুন।
- আপনি যে তার ব্যাপারে তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন সেটা সুযোগ পেলে তাকে বুঝিয়ে দিন।
- তার প্রত্যেকটি বিষয়ের পড়াশুনার খোঁজ খবর নিন যেন সে মনে করে তার সমস্যা সমাধানে একজন সঙ্গি রয়েছে।
৯। সন্তানকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করুন
আপনি কি প্রায়ই সন্তানের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন? নিচের বিষয়গুলো দেখুন যা অনেক বাবা-মা’ই সন্তানের সাথে করে থাকেন যা সন্তানকে পড়াশুনায় অমনোযোগী হতে বাধ্য করে-
- ভালো রেজাল্ট করলে সাইকেল কিনে দেওয়ার কথা বলে না দেওয়া।
- ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে না নিয়ে যাওয়া।
- তার বন্ধু কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে না নেওয়া, ইত্যাদি।
যদি বাবা-মা হিসেবে আপনার মধ্যেও এরকম অভ্যাস থাকে, তবে আজই তা ত্যাগ করুন। তা না হলে আপনার শিশু আপনার প্রতি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। যার প্রভাব তার পড়াশুনার মধ্যেও পড়বে। আপনার সাধ্যের বাহিরে এমন প্রতিশ্রুতি দিবেন না বরং সাধ্যের ভেতরে যতটুকু আছে তা দিয়ে উৎসাহ দিতে পারেন।
১০। সর্বোপরি তার বন্ধু হোন
হাতে সময় পেলেই সন্তানকে সময় দিন। এতে করে সে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে। মাঝে মাঝে তাকে পার্কে কিংবা সুন্দর জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যান। তাকে নিয়ে তার পছন্দের খাবার খান, ধর্মীয় অনুশাসনা মেনে চলুন এবং তাকেও শিক্ষা দিন। তার সাথে সহপাঠীর ভুমিকা পালন করুন, তার সাথে বিকালে মাঠে খেলুন। পড়ার টেবিলে তার সহপাঠী হোন, সর্বোপরি তার ভালো বন্ধু হোন।
এই ১০টি কৌশল আপনি আপনার সন্তানের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করুন, নিশ্চয়ই সে পড়াশুনায় মনোযোগী হবে। আমরা আপনার সন্তানকে পড়াশুনায় মনোযোগী করার কৌশল হিসেবে ১০টি বিষয় তুলে এনেছি। তবে আপনি আপনার সন্তানের সাথে আরো ভালোবাসা দিয়ে তাদের মনে জায়গা করে নিতে পারেন। অবশ্যই এই কৌশলগুলো আপনার পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে জানাতে ভুলবেন না। লেখাটি কেমন লেগেছে সেটাও জানাবেন, নিচের কমেন্ট বক্সে; আপনার কাছে আরো কোনও ভাল কৌশল থাকলে সেটাও কমেন্টে জানান।
Leave a Reply