সুবিশাল এ মহাকাশে কত কিছু যে ঘটেছিলো, কত কিছু ঘটে, কত কিছু ঘটবে বলে ধারণা করা হয় তার ইয়ত্তা নেই। মহাকাশে তারার সংখ্যা যেমন অগণিত, তেমনই বিভিন্ন সম্ভাব্য ঘটনার পরিমানও অগণিত। মানবজাতি এখনো পর্যন্ত মহাকাশ সম্পর্কে কত শতাংশ জ্ঞান অর্জন করেছে, তা জানারও উপায় নেই। কারণ মহাকাশের বিস্তার আমাদের ধারণার বাইরে।
সমস্ত জ্ঞানভান্ডার এ মহাকাশে নিহিত। সমগ্র মহাকাশে আমাদের এ বিশাল পৃথিবী তুলনামূলকভাবে একটি বিন্দুর কয়েক বিলিয়ন ভাগের এক ভাগের চেয়েও ক্ষুদ্র। বরং, আমাদের সৌরজগৎও এ মহাবিশ্বে অগণিত পরিমান সৌরজগৎ এর মধ্যে একটি।
একের অধিক গ্রহ উপগ্রহ মিলে তৈরি হয় একেকটি সৌরজগৎ। এমন অসংখ্য সৌরজগৎ নিয়ে গঠিত আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মতোই অগণিত পরিমান গ্যালাক্সি নিয়ে গঠিত হয় Laniakea, যেটিকে গ্যালাক্সিসমূহের সুপারক্লাস্টার বলা হয়।
আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি এই সুপারক্লাস্টার লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সির মধ্যে একটি। তেমনভাবেই, Laniakea’র মত অসংখ্য সুপারক্লাস্টার নিয়ে গঠিত হয় ‘কসমিক ওয়েব’। এ কসমিক ওয়েব হলো বিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালাক্সির সমষ্টি। এমন অগণিত কসমিক ওয়েব নিয়েই গঠিত আমাদের Universe বা মহাবিশ্ব। একের অধিক Universe নিয়ে গঠিত হয় Multiverse, যাতে প্রকৃতির ভিন্ন নিয়ম সম্পন্ন গ্রহ উপগ্রহ থাকতে পারে।
এ সুবিশাল মহাকাশে প্রতিনিয়ত কত কিছুই ঘটে যাচ্ছে যার খুবই ক্ষুদ্র একটি অংশ হয়তো মাঝেমাঝে মানবজাতির চোখে পড়ছে। আর বাকি সবটাই রয়ে যাচ্ছে অজানা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সর্বক্ষণ মহাকাশে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে যেন মানবজাতির দৃষ্টি সীমানায় যা কিছু ঘটছে তা উপলব্ধি করতে পারে।
উন্নতমানের টেলিস্কোপের সাহায্যে মানবজাতি এখন মহাকাশ সম্পর্কে অনেক অনেক জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, যদিও তা মহাবিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আপনার কাছে টেলিস্কোপ না থাকলেও আপনি আপনার স্মার্টফোনকে বানিয়ে নিতে পারেন মহাকাশ ভ্রমণের বাহন। ফলে, এটি দিয়ে আপনি হয়তো মহাকাশ সম্পর্কে কিছুটা আইডিয়া পেতে পারেন।
প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণের ফলে আজ পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে মহাবিশ্বের অসংখ্য বিস্ময়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে। তার মধ্যে সম্প্রতি তারা যা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে তা হলো দানবীয় নক্ষত্র ‘বিটেলজুস’ এর উজ্জ্বলতায় হঠাৎ হ্রাস।
এ ঘটনায় বিভিন্ন মিডিয়া বিভিন্ন রকম প্রশ্ন তুলেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে। বেশিরভাগ প্রশ্নেই পৃথিবীর উপর এ ঘটনার প্রভাব সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পেয়েছে। এ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হওয়ার আগে আমাদের জানা উচিত বিটেলজুস কি এবং এর উজ্জ্বলতা হ্রাসের সাথে পৃথিবীর উপর প্রভাব পড়ার সম্পর্ক কি।
বিটেলজুস কি?
‘Betelgeuse’, বাংলা উচ্চারণ হলো ‘বিটেলজুস’, যা অবস্থান করছে পৃথিবী থেকে প্রায় ৬৪২ আলোকবর্ষ (১ আলোকবর্ষ = প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন মাইল) দূরে। একে ‘কালপুরুষ’ বা ‘শিকারি’ নামক তারামণ্ডলের ‘আলফা’ নক্ষত্র বলা হয়, যা দ্বারা বুঝায় এটি কালপুরুষ তারামণ্ডল এর সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্র।
কালপুরুষ তারামণ্ডল উত্তর দিকের আকাশে শীতের শেষের দিক হতে বসন্তের শুরুর দিক পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় থাকে। বিটেলজুস কালপুরুষ এর বাম কাঁধের প্রতীক হিসেবে অবস্থান করে। এর ব্যাস হলো আনুমানিক ৭৬৭ মিলিয়ন মাইল বা প্রায় ১.২ বিলিয়ন কিলোমিটার।
রক্তিম বর্ণের অতিদানবীয় এই তারার ভর সূর্যের চেয়ে ১২ গুন বেশি। আনুমানিক ৯-১০ মিলিয়ন বছরের এই দানব ধীরে ধীরে তার জীবনসমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সূর্যের বয়স যদিও প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর, সূর্য এখনো তার মধ্যবয়স্ক জীবনে রয়েছে। কারণ, বিটেলজুসের মত অতিদানবীয় তারাগুলো সূর্যের মত মাঝারি আকারের তারার তুলনায় অত্যাধিক তাড়াতাড়ি তাদের থার্মোনিউক্লিয়ার জ্বালানি ক্ষয় করে ফেলে।
বিটেলজুস এর উজ্জ্বলতা হ্রাস
সম্প্রতি একটি খবর যা জ্যোতির্বিদ্যা প্রেমীদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তা হলো, এই বিটেলজুসের উজ্জ্বলতা আকস্মিকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরের শুরুর দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বিটেলজুসের উজ্জলতায় এ আকস্মিক হ্রাস লক্ষ করেন।
মহাবিশ্বে উজ্জ্বলতার দিক থেকে এক সময়কার শীর্ষ ১০-এ থাকা এ তারাটির ২০১৯-এর ডিসেম্বরের শেষের দিকে ২১-তম স্থানে অবনতি ঘটে। এমন আকস্মিক লক্ষণীয় পরিবর্তনের কারণে বিটেলজুস সম্প্রতি বহু খবরের শিরোনামে অবস্থান করছে।
অনেক গণমাধ্যম দাবি করছে যে, বিটেলজুসের এই উজ্জ্বলতার হ্রাস প্রমান করে যে এটি ধীরে ধীরে একটি প্রচণ্ড ভয়াবহ বিস্ফোরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি গণমাধ্যম এ ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন তুলছে। যেমন, এই বিস্ফোরণ পৃথিবীর উপর কেমন প্রভাব ফেলবে?
বিটেলজুসের এ আকস্মিক উজ্জ্বলতা হ্রাস সহজাতভাবে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিটেলজুস কে ‘ভ্যারিয়েবল স্টার’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিলো অনেক আগেই। ‘ভ্যারিয়েবল স্টার’ বলতে সে-সব তারাকে বুঝায় যেগুলোর উজ্জ্বলতা কালভেদে ওঠানামা করে।
তারাটির উজ্জ্বলতার ওঠানামার একাধিক চক্র রয়েছে। একটি ৫.৯-বছরের মূল চক্র এবং এর মাঝে কিছু ছোট ছোট চক্র। ধারণা করা যায়, যখন সবগুলো চক্রের ক্ষুদ্রতম অংশ একত্রিত হয়, তখন তারাটি অত্যন্ত ক্ষীণ দেখায়, যেমনটা এখন দেখাচ্ছে।
এখানে আরো কিছু সম্ভাব্য বিষয় রয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমনও ধারণা করছেন যে, বিটেলজুসের উজ্জ্বলতার এ পরিবর্তন কোনো ধরনের গ্যাসীয় বা ধূলিকণা জনিত অগ্ন্যুৎপাতের কারণেও হতে পারে। অথবা, তারাটির ভুতলের উজ্জ্বলতার কারণেও এ পরিবর্তন হতে পারে।
এ ঘটনা সম্পর্কে জোতির্বিজ্ঞানীরা কি বলেন?
বিটেলজুস আদৌ বিস্ফোরিত হবে কি না সে প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়-হ্যাঁ। তবে তা আমাদের জীবনকালে নয়। বর্তমানে আমরা যতদূর জানি, অতিদানবীয় তারাগুলো লাল হোক বা নীল হোক, তারা প্রচন্ড বিস্ফোরণের মাধ্যমেই জীবন শেষ করে। তবে বিটেলজুসের ক্ষেত্রে এই ঘটনা আগামী কয়েক লক্ষ বছরের মধ্যে যে-কোনো সময় ঘটতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেশিরভাগ জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন না কোনো বিস্ফোরণ সন্নিকটে। উদাহরণস্বরূপ, ভিলানোভা ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়াসাটনিক এবং এডওয়ার্ড গিনান দাবি করেন, বর্তমানের উজ্জ্বলতার ওঠানামাটি মূল ৫.৯-বছরের মধ্যে ৪২৫ দিনের একটি অস্বাভাবিকভাবে চরম চক্রের কারণে ঘটে। এটি অবশ্যই অস্বাভাবিক, কিন্তু তা অনিবার্য এক বিস্ফোরণকে নির্দেশ করে এমন কিছু নয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে কোনো তারার উজ্জ্বলতার হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে বিস্ফোরিত হওয়ার ঘটনার নজির নেই। যদিও এমন অসাধারণ ঘটনা কখনো পর্যবেক্ষণ করা হয়নি, তবুও এ কারণটি একেবারে বাতিলও করা যায় না। তবে, বিস্ফোরণের আগে উজ্জ্বলতার তারতম্যের এই ধাপের অস্তিত্ব ছিলো নাকি তা পরীক্ষণের কোনো কম্পিউটার মডিউল নেই।
তবে এটি বলা যায় যে, সুপারনোভা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা অনেকটা অযথাযথ বিজ্ঞান। কিন্তু তবুও একটা সম্ভাবনা রয়েই যায়, দুরসম্ভাবনাই হোক না কেন, যে বিটেলজুস আগামীকালও বিস্ফোরিত হতে পারে। অথবা এমনভাবেও বলা যায় যে, বিটেলজুস ৬৪২ বছর আগে বিস্ফোরিত হয়েছে এবং সে আলো আমাদের চোখে পৌঁছাতে আর দেরি নেই।
পৃথিবীর উপর এ ঘটনার প্রভাব
মূল প্রশ্ন হলো, যদি বিটেলজুস আদৌ বিস্ফোরিত হয়, তাহলে পৃথিবীর কি হবে? এর উত্তরে বলা যায়, পৃথিবীর উপর এই বিস্ফোরণের কোনো প্রভাবই পড়বে না। কারণ, পৃথিবী বিটেলজুস এর থেকে যথেষ্ট দূরত্বে আছে সুতরাং পৃথিবীতে এর কোনো ভালো বা খারাপ প্রভাব পড়বে না।
তবে হ্যাঁ, বিটেলজুস যেদিন বিস্ফোরিত হবে, সেদিন পৃথিবীবাসী একটি অসাধারণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হবে, যা ভুলার মত নয়। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধারণা, বিটেলজুস নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা শীঘ্রই তার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে এবং উজ্জ্বলতার দিক থেকে আবারও শীর্ষ দশে ফিরে যাবে।
সুতরাং, এ ব্যাপারে মানবজাতির দিন গণনা ছাড়া আর কিছু করার নেই। বরং, এমন অসাধারণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার জন্য আমাদের সর্বদা প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ, এমন ঘটনা নিজ চোখে দেখার সৌভাগ্য কারো হাতছাড়া করা উচিত নয়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সর্বক্ষণ বিটেলজুস এর প্রতি লক্ষ্য রাখছেন, প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছেন। বিটেলজুস হয়তো এখনই বিস্ফোরিত হয়েছে কিন্তু আমাদের চোখে তা পৌঁছাতে ৬৪২ বছর লাগবে। অথবা ৬৪২ বছর আগেই বিস্ফোরিত হয়েছে এবং কালই আমরা এ অসাধারণ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হবো। এমন অসংখ্য সম্ভাবনা নিয়েই আমাদের এ সুবিশাল মহাবিশ্ব গঠিত।
Leave a Reply