ত্বকের জন্যে ভিটামিন এর প্রয়োজনীয়তা জেনে নিন, যদি তারুণ্য দীপ্ত ত্বকের অধিকারী হতে চান। আমরা সবাই কমবেশি চিরযৌবনা ত্বকের প্রত্যাশী। দাগহীন কোমল তারুণ্যোজ্জ্বল ত্বকের চাহিদা নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলেরই রয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতির দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাই, পণ্য রপ্তানি হতে আয়ের প্রায় সিংহভাগই আসে প্রসাধনী সামগ্রীর দিক থেকে। যারফলে, গড়ে উঠেছে অসংখ্য কসমেটিক কোম্পানী। আপনি নিশ্চয়ই আমেরিকার ৫টি বিখ্যাত কসমেটিক কোম্পানী সম্পর্কে জানেন যারা ডমিনেট করছে গোটা কসমেটিক দুনিয়া।
এছাড়া, দেশী-বিদেশী ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে পন্ডস, লরিয়েল, ফেয়ার এন্ড লাভলী থেকে শুরু করে বিভিন্ন হারবাল প্রোডাক্ট, আয়ুর্বেদিক প্রোডাক্ট বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। পণ্যের সাথে সাথে কোম্পানীগুলো জুড়ে দিচ্ছে চ্যালেঞ্জ এবং অর্জণ করছে ক্রেতার বিশ্বাসযোগ্যতা। কিন্তু ঠিকই বয়সের করাল গ্রাস এবং পুষ্টিহীনতার অভাবে তলিয়ে যাচ্ছে এ-সব প্রসাধনীর কার্যকারিতা।
প্রকৃতপক্ষে ত্বকের সৌন্দর্য্য খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেই নিহিত। খাদ্যগ্রহণ হতে প্রাপ্ত ভিটামিন এবং মিনারেলগুলো ত্বকের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে আপনাকে দিতে পারে তারুণ্যোজ্জ্বল ত্বকের সন্ধান। এছাড়া, ত্বকের যাবতীয় সমস্যার সমাধান সম্ভব খাদ্য হতে প্রাপ্ত ভিটামিন এবং মিনারেলস হতেই।
ত্বকের জন্যে ভিটামিন ও মিনারেলস
আমরা অনেকেই জানি দাম্পত্য সুখের জন্যে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন প্রয়োজন, আবার অনেকেই জানি না যে ত্বকের জন্যেও এ-রকম ১০টি ভিটামিন দরকার। আসুন, ত্বকের স্বাস্থ্য রক্ষায় দরকারি এই ভিটামিনগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
১. ত্বকের যত্নে ভিটামিন-এ
ভিটামিন-এ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। ত্বককে সতেজ রাখতে এবং রিংকেলস নিরাময়ে এর অনন্য, অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। সূর্যের ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি হতে ত্বককে রক্ষা করে এই গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন। এছাড়াও, ভিটামিন-এ দৃষ্টিশক্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে, দৃষ্টিশক্তিজনিত সমস্যা নিরাময়ে এবং ফুসফুস ক্যান্সার রোধে ভূমিকা রাখে।
যেভাবে পাবেন ভিটামিন এ-
উদ্ভিজ্জ উৎসঃ মিষ্টি আলু, গাজর, শাক, আম, পাকা পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, পালংশাক, এবং কচুঁশাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়।
প্রানিজ উৎসঃ গরুর মাংস, ডিম, কলিজা। গরুর দুধে রেটনয়েড নামক এক ধরনের উপাদান থাকে যা ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে সহায়তা করে।
২. স্বাস্থোজ্জ্বল ত্বকের জন্যে ভিটামিন সি
ত্বকের যত্নে ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা সম্পর্কে কম-বেশি সবাই জানি। ত্বকের পাশাপাশি সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। একজন ব্যক্তির দৈনিক ১০০০ মি.গ্রা ভিটামিন-সি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ভিটামিন সি কোলাজেন নামক এক ধরনের সংযোজক টিস্যু উৎপন্ন করে যা আপনার ত্বককে সুদৃঢ় রাখতে সহায়তা করে। এটি একটি সুপরিচিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা আপনার ত্বকের প্রদাহ রোধ করে, এবং ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণে রাখে। এছাড়া রোদে পোড়া দাগ, ফ্যাকাসে ভাব দূর করে ত্বকের ক্ষতির দিকটা অনেকটা পুষিয়ে নেয় ভিটামিন সি। জেনে নিন আমাদের শরীরে ভিটামিন সি এর কাজ কি।
যেভাবে পাবেন ভিটামিন সি-
- লেবু-জাতীয় ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। যেমন- কমলা লেবু, বাতাবি লেবু, পাতি লেবু, কাগজি লেবু।
- আমলকি ভিটামিন-সি এর সর্বোত্তম উৎস। আমলকিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
- আমড়া, স্ট্রবেরি, ব্রকলি, কাঁচা মরিচ এবং টমেটোতে ভিটামিন সি রয়েছে।
৩. ত্বকের সৌন্দর্য রক্ষায় ভিটামিন ই
ত্বককে সুন্দর করতে ভিটামিন-ই তে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট অন্যান্য ভিটামিনের তুলনায় বহুগুণ কার্যকরী। হাভার্ড হেলথ পাবলিকেশনের তথ্যানুযায়ী, পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন-ই গ্রহণের ফলে ভিটামিন-ই এর স্টোরগুলো সুরক্ষিত থাকে। নানা কারণে প্রয়োজনীয় এই ভিটামিন রেডিকেল ক্ষয় হতে ত্বককে বাঁচায়। ব্রণ এবং দাগযুক্ত ত্বকের জন্যে ভিটামিন ই একটি কার্যকর টনিক। এটি ত্বককে কোমল এবং মসৃণ করে।
ভিটামিন-ই এর উৎস সমূহ-
- বাদাম জাতীয় খাবার যেমন- কাঠবাদাম, কাজুবাদাম, চীনাবাদামে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই পাওয়া যায়।
- বিভিন্ন ধরনের শস্য জাতীয় বীজ যেমন – ভূট্টা, তিল, সরিষা, সয়াবিন এ ভিটামিন ই থাকে।
- উদ্ভিজ্জ তেল, ওলিভ ওয়েল এবং ভালো তেল সমৃদ্ধ খাবারে ভিটামিন ই থাকে।
৪. ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখে ভিটামিন ডি
সূর্যরশ্মি হতে পাওয়া এ ভিটামিন “সানশাইন ভিটামিন” নামে পরিচিত। উত্তর জলবায়ুতে বসবাসকারী বেশিরভাগ লোকই এ ভিটামিন হতে বঞ্চিত। যার ফলে, তাদের ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ বিভিন্ন খাবার হতে এ ভিটামিন সংগ্রহ করতে হয়।
রিকেটস রোগের জন্য ভিটামিন-ডি কার্যকরী। লিনিয়াস পলিং ইনস্টিটিউট (LPI) এর গবেষণা প্রবন্ধে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির দৈনিক ৬০০ ইউনিট সূর্যালোক গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি অন্তঃসত্ত্বা বা ৭০ বছরের বেশি বয়স হয়ে থাকে, তবে তার ক্ষেত্রে আরও বেশি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
ত্বকে ব্রণের সংক্রমণ রোধে এই ভিটামিন একজন প্রতিরক্ষা প্রহরীর ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ভিটামিন-ডি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং বলিরেখা কমায়। স্কিন টোন বাড়ায়।
বিভিন্নভাবে ভিটামিন-ডি গ্রহণ করতে পারেন-
- ১০ মিনিট সূর্যালোকে থাকা। সূর্যালোক জনিত কোনো সমস্যা থাকলে অবশ্য ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া। স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকলেও এভাবে ভিটামিন-ডি গ্রহণ এড়িয়ে চলুন।
- শক্তি উৎপাদনকারী খাদ্য গ্রহণ করা। যেমন- সিরিয়ালস, কমলার রস এবং টকদই।
- হাঙর এবং কড মাছ খাওয়া।
৫. ত্বকের ক্ষত সারাতে ভিটামিন কে
ত্বকের ক্ষতস্থান নিরাময়ের ক্ষেত্রে ভিটামিন কে প্রয়োজনীয়। ভিটামিন কে এর অভাবে ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বাঁধে না। ত্বকের বিভিন্ন স্থানে ইনফেকশন এবং রক্তক্ষরণ এ ভিটামিন কে দ্রুত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে।
এছাড়া, চোখের নিচে ডার্কসার্কেল, কালো দাগ, ত্বকের ফ্যাকাসে ভাব দূর করে। ভিটামিন কে ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং ত্বককে সতেজ ও আকর্ষণীয় করে তোলে।
যে-সব খাবারে পাচ্ছেন ভিটামিন কে-
- বাঁধাকপি, বিভিন্ন ধরনের শাক, শতমূলী।
- দুধ, ডিম এবং কলিজা।
- শালগম, লেটুস, ব্রকলি।
৬. স্বাস্থ্যকর ত্বকের জন্যে ভিটামিন বি-৩
ভিটামিন বি-৩ নায়াসিন নামেও পরিচিত। এটি প্রাণী এবং উদ্ভিদ উভয় খাবারে পাওয়া যায়। এই ভিটামিন স্বাস্থ্যকর ত্বকের জন্যে প্রয়োজনীয়। পাশাপাশি মস্তিষ্ক, স্নায়ুতন্ত্র এবং রক্তকণিকার জন্যও প্রয়োজনীয়।
ত্বকের জন্য তৈরি বিউটি প্রোডাক্টগুলোর প্রায়শই নিয়াসিনামাইডের সমন্বয়ে তৈরি হয়। ত্বকের বয়স্কভাব উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। ত্বকের লালচে ভাব দূর করতেও এর চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। ভিটামিন বি-৩ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে পারেন।
ভিটামিন বি-৩ সমৃদ্ধ খাবার-
- মুরগী ও টার্কির মাংস
- চিনাবাদাম
৭. সতেজ ত্বকের জন্যে ভিটামিন বি-৫
ভিটামিন বি-৫ প্যান্থোথেনিক এসিড বা প্যান্থানল হিসাবে পরিচিত। এই ভিটামিন ত্বকের সুরক্ষা প্রদান করে ত্বককে করে তোলে উজ্জ্বল এবং সজীব। ত্বকের লোমকূপগুলোর মধ্যে পানি এবং বায়ু চলাচলের পথ সুগম করে।
ত্বকের যে-কোনো ইনফেকশনে প্যান্থানল বাঁধা সৃষ্টি করে। সুতরাং, আপনি যদি কোনো বিউটি প্রোডাক্ট কিনিতে যান, তাহলে প্যান্থানলের উপস্থিতি নিশ্চিত করা নিঃসন্দেহে একটি ভালো দরদামের সঙ্গে সমতুল্য।
ভিটামিন বি-৫ সমৃদ্ধ খাবার-
- বিভিন্ন শস্যদানা। যেমন- ভূট্টা, সয়াবিন, তিল।
- অ্যাভোকাডো।
- মুরগীর মাংস এবং স্যালমন মাছ।
৮. ত্বকের কোষ রক্ষায় কোলাইন
কোলাইন হলো এমন একটি ভিটামিন যা দেহ নিজ থেকেই তৈরি করতে পারে। সাধারণভাবে নিউরো ট্রান্সমিটার সংশ্লেষণ এবং সাধারণ মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য এ ভিটামিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, এফএএসইবি জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, এই ভিটামিন ত্বকের কোষের ঝিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও শরীর নিজেই এ ভিটামিন তৈরি করে, তবুও ভাল উৎস হতে এ ভিটামিন সংগ্রহ করা ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্যে আরও বেশি উপকারী।
কোলাইন সংগ্রহের উৎস-
- চিনাবাদাম
- দুধ, ডিম
৯. ত্বকের দৃঢ়তা বাড়াতে ফলিক অ্যাসিড
ফলিক অ্যাসিড ভিটামিন বি-নাইন নামেও পরিচিত। শিশুর বিকাশের জন্য গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত ফলিক অ্যাসিড গুরুত্বপূর্ণ। যে-কোন নতুন কোষ তৈরীতেও এর প্রয়োজনীয়তা সর্বজনবিদিত। ত্বকের স্বাস্থ্য এবং চেহেরার উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
জার্নাল অব কসমেটিক ডার্মাটোলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, ফলিক অ্যাসিড এবং ক্রাইটাইন নামক এক ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিডের মিশ্রণের সাময়িক প্রয়োগ কোলাজেন সংশ্লেষণকে বাড়িয়ে ত্বকের অন্তঃস্ত টিস্যুর দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে।
ফলিক অ্যাসিড পাবেন যে সকল খাবারে-
- বিভিন্ন ধরনের ডাল, বিশেষ করে লবিয়া, মুগডালে ফলিক অ্যাসিড থাকে।
- পালংশাক এবং অ্যাস্পারাগাস এ ফলিক অ্যাসিড থাকে।
১০. ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ত্বকের প্রদাহ দূর করে
চর্বি আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর এটা আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু ডায়েটের ফলে অল্প চর্বি চামড়াকে শুকিয়ে এবং কুঁচকে ফেলে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড শরীর তৈরী করতে পারে না। এই ফ্যাটি এসিড কোষপ্রাচীর তৈরী করে এবং স্কিনে ক্যান্সার কোষের জন্মানোকে ব্যাহত করে।
পাশাপাশি এটি চর্মের প্রদাহ রোধেও ভূমিকা রাখে। তাই, খাবারে হালকা চর্বি রাখুন। এক্ষেত্রে, মনোস্যাচুরেটেড, পলিস্যাচুরেটেড চর্বি স্যাচুরেটেড চর্বির তুলনায় স্বাস্থ্যকর। এটি ত্বকের ময়েশ্চারাইজিং-এ ভূমিকা রাখে এবং ত্বককে কোমল, নমনীয় করে তোলে।
নিরাপদ মাত্রার চর্বিযুক্ত খাবার-
- বাদাম, বীজ, শস্যদানা।
- অ্যাভোকাডো এবং মাছ।
ত্বক আসল পুষ্টি পায় খাদ্য থেকে। খাদ্য থেকে প্রাপ্ত পুষ্টিই ত্বককে উজ্জীবিত করে ত্বকের সৌন্দর্য পুনরুদ্ধার করে। তাই, চলুন প্রসাধনীর উপর বরাদ্দ ব্যয়টুকু ত্বকের জন্যে ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার সংগ্রহে ব্যয় করি। ত্বককে তারুণ্যোদ্দীপ্ত রাখি। বার্ধক্যেও ত্বকের তারুণ্য অটুট থাকুক।
Leave a Reply