ডিপ্রেশন শব্দটা আজকের যুগে খুবই সাধারণ একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যে-কোন বয়সের মানুষই কম-বেশি বিভিন্ন কারণে ডিপ্রেশনে ভুগছেন। ডিপ্রেশনের কারণ জানা যে কারো জন্যেই আবশ্যক। সেই সাথে, সবার জন্যেই ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো লক্ষ্য করা উচিৎ। একই সাথে, ডিপ্রেশন থেকে মুক্তির উপায় জেনে রাখা সবারই প্রয়োজন।
ডিপ্রেশন একজন মানুষের জন্য ক্ষতিকর জেনেও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি খুব কম মানুষেরই আছে। তবে সেটার শতকরা হার অনেক কম। ডিপ্রেশন এক ধরণের মানসিক চাপ। প্রচন্ড মানসিক চাপে পড়লে করণীয় কিছু কাজ আছে যা দ্বারা এর থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
আমি নিজেও একটা সময় খুব বেশি ডিপ্রেশনে ভুগেছি। সেটা থেকে একের পর এক আমার জীবনে অনেক খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীনও হয়েছি। অনেক বেশি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি। তাই, একজন ডিপ্রেশনে থাকা মানুষের যন্ত্রণা কতটুকু আমি বুঝি। আর সেটা থেকেই চেষ্টা করছি এমন কিছু কথা বলার যা হয়তো আপনাদের কাজে আসতে পারে।
প্রতিটি মানুষই ডিপ্রেশনের কারণে খারাপ অনুভুতির সম্মুখীন হন। যদিও সময়ের সাথে সাথে এটি এক সময় আর থাকে না। কিন্তু সেই সময়টা পার করাটাই অনেক বেশি কষ্টদায়ক। একজন মানুষ যখন ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেন, তখন এটা তার দৈনন্দিন কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে বাধা দেয়।
ডিপ্রেশনে থাকা অবস্থায় স্কুল-কলেজে যাওয়া, বাচ্চাদের দেখাশোনা করার মতো কাজগুলিও ঠিকভাবে করা যায় না। এমনকি ব্যক্তিগত আচার ব্যবহারেও নেতিবাচক পরিবর্তণ আসতে শুরু করে। এর কারণে বন্ধু-বান্ধবসহ পরিবারের সদস্যদের সাথেও সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে।
ডিপ্রেশনকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর রোগ বলে মনে করি। কারণ, অন্যান্য যে কোন রোগ শুধুমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তিকেই কষ্ট দেয়। কিন্তু এটি এমনই একটি রোগ যা আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সাথে তাকে যারা ভালোবাসে তাদেরকেও কষ্ট দিতে শুরু করে।
পরিস্থিতিভেদে মানুষ বিভিন্ন ধরনের ডিপ্রেশনে ভোগেন। এটি সাধারণ হলেও এর ব্যপ্তি অনেক মারাত্বক। ডিপ্রেশন শারীরিক বা মানসিক যে কোন ধরনেরই হতে পারে। তাই, অবশ্যই এটি থেকে মুক্তি পেতে হলে এর কারণ, লক্ষন ও এটি থেকে মুক্তির উপায় জানতে হবে।
ডিপ্রেশন কি?
ডিপ্রেশন একটি মুড ডিজঅর্ডার। মেডিকেলের ভাষায় এটিকে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারও বলা হয়ে থাকে। মানুষের মনের নানা রকম খারাপ অবস্থার চূড়ান্ত পরিণতি এটি, যাকে সহজ বাংলায় বিষন্নতা বলা হয়ে থাকে। সাধারণত, এ ধরণের পরিস্থিতিতে একজন মানুষ দু:খবোধের মতো দীর্ঘস্থায়ী অনুভূতিতে পতিত হয়ে থাকেন। অধিকাংশ সময়ই কোন কিছুতে আগ্রহ বোধ করা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন।
সাধারণত, একজন স্বাভাবিক মানুষের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই মেজাজের একটা উঠা-নামা হয়। কিন্তু ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষের ক্ষেত্রটা ভিন্ন, তারা প্রায় সব সময়ই একটা বিষন্ন ভাবের ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করে থাকেন। আর এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড় ধরণের কোন ঘটনা বা দূর্ঘটনা থেকে হয়ে থাকে।
ডিপ্রেশন একটি চলমান সমস্যা, এটি পাসিং কোন প্রবলেম নয়। এটি দিনকে দিন ধরে, মাসের পর মাস ধরে কিংবা বছরের পর বছর ধরেও চলতে পারে। আর এটি একজন মানুষকে শুধু মানসিক সমস্যাতেই ফেলে রাখে না। বরং ধীরে ধীরে নানা রকম শারিরীক সমস্যার দিকে নিয়ে যায় যা তাকে ঘরে কিংবা কর্মস্থলে বিভিন্ন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করে তোলে। ডিপ্রেশন থেকে হতে পারে অনেক বড় ধরণের রোগও। যেমন-
- Arthritis বা বাত রোগ
- Asthma বা হাপানি রোগ
- Cardiovascular disease – নানা রকমের হৃৎরোগ
- Cancer – ক্যান্সার
- Diabetes – ডায়াবেটিস
- Obesity – স্থুলতা বা মুটিয়ে যাওয়া
ডিপ্রেশনের কারণঃ
ডিপ্রেশন ঠিক কি কি কারণে হয় এটার কোন সীমা আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে ব্রেইন এন্ড বিহেভিয়র রিসার্চ ফাউন্ডেশন এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এর মধ্যে কিছু সাধারণ বিষয় আমি তুলে ধরছি।
- যদি কারো পরিবারক্রমে এমন মানুষের সংখ্যা বেশি হয়, তাহলে এটিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- প্রেম-ভালোবাসার মত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলে বা স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের মত ঘটনা ঘটলে।
- কিছু বিশেষ রোগ, যেমন ক্যান্সার বা হার্টের অসুখের মত মারাত্বক অসুখে ভুগলে।
- হাইপার টেনশন প্রতিরোধী ঔষধ নিয়মিতভাবে নেওয়ার অভ্যাস থাকলে সেটা থেকেও ডিপ্রেশন হতে পারে।
- আর উপরের সবগুলির চেয়ে ভয়াবহ কারণ হচ্ছে হতাশা। কিছু মানুষ নিজেদের সব সময় ব্যর্থ ভাবেন এবং নিজেকে অনেক ছোট করে দেখেন যা থাকে ডিপ্রেশন সৃষ্টি হয়।
অপব্যবহার বা অপমাণ: কারো অতীত জীবনের শারীরিক নির্যাতন পরবর্তীতে তার জীবনে ডিপ্রেশনের জন্ম দিতে পারে। যৌন বা মানসিক নির্যাতনও পরবর্তী জীবনে ক্লিনিকাল হতাশার জন্ম দিতে পারে।
ব্যক্তি বা পারিবারিক দ্বন্দ: ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ, কিংবা পরিবারের সকল সদস্যদের সঙ্গে যদি কোন মানসিক দ্বন্দ দেখা দেয়, তব সেখান থেকে কোন ব্যক্তির মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। এমনকি, সহকর্মী কিংবা বন্ধুদের সাথে বিরোধের ফলেও অনেকের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা দেয়।
প্রিয়জনের মৃত্যু: প্রিয়জনের হঠাৎ মৃত্যুও অনেকের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়। যদিও জীবনের মালিক আল্লাহ এবং মৃত্যুর মালিকও আল্লাহ; তিনিই জীবন দানকারী, তিনিই মৃত্যু দানকারী আর তার হুকুমেই মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে, তবু প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যাথা থেকে কারো কারো ডিপ্রেশন হয়।
ঘটনা বা দূর্ঘটনা: কারো জীবনে যখন বড় ধরণের কোন ঘটনা ঘটে, যদিও সেগুলো আনন্দের, তবু সেগুলো থেকেও অনেকেই অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে হতাশায় পড়ে যায়। যেমন, নতুন চাকরি, গ্র্যাজুয়েশন শেষ কিংবা বিয়ের মতো আনন্দদায়ক ঘটনাও অনেককেই ডিপ্রেশনে ফেলে দেয়। আবার অন্যদিকে বড় ধরণের দূর্ঘটনাও অনেক মানুষকেই দীর্ঘ সময় ধরে হতাশায় ভোগায়। যেমন, চাকরি হারানো, স্বামী বা স্ত্রী’র সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ, ইত্যাদি।
ডিপ্রেশনের লক্ষণ সমূহঃ
- প্রতিনিয়ত দুঃখী, হতাশা গ্রস্থ বা শূণ্যতা বোধ হওয়া।
- সচরাচর নিরাশ হয়ে যাওয়া।
- মনের মধ্যে অপরাধ ও অসহায়ত্ববোধ করা।
- ক্লান্তি অনুভব হতে থাকা।
- আগে ভালো লাগতো এমন কাজগুলির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
- সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা।
- অনিদ্রা রোগে ভোগা। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে না পারা।
- আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসা বা তেমন কিছু করার চেষ্টা করা।
- প্রতিনিয়ত মাথা ব্যথাসহ খাবার হজম করতে সমস্যা হওয়ার মতো রোগে ভোগা।
পরীক্ষা করাঃ
এ ধরনের রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রথমে রোগীর সম্পুর্ণ ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়া জরুরী। এছাড়া, যদি শারিরীক কারণে এটি হয়ে থাকে, তাহলে রক্তে এ্যানেমিয়া বা থাইরয়েড নির্ণয়ের মাধ্যমে এটি সনাক্ত করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসাঃ
সাধারণত মেডিকেল কাউন্সিলিং বা কিছু ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসকের আর কোন উপায় থাকে না। চিকিৎসার জন্য তারা রোগীকে বিভিন্ন ধরনের এন্টি-ডিপ্রেশন মেডিসিন দিয়ে থাকেন যা ডিপ্রেশনের লক্ষণকে অনেকখানি দুর করতে সক্ষম। এছাড়া ফিজিওথেরাপীর মাধ্যমেও ডিপ্রেশনকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
নিজেই সমস্যার সমাধান করুন:
- এমন কোন কিছুর আশা করবেন না যা সাধারণভাবেই আপনি করতে পারেন না। সবকিছু বাস্তবিকতার মাপকাঠিতে ভাবা শুরু করুন।
- নিজের নেতিবাচক ভাবগুলোকে কখনোই বিশ্বাস করবেন না। নিজেকে দোষারোপ করা বা কোন কিছু করার আগেই সেটাতে ব্যর্থ হবেন এমনটা ভাবা বন্ধ করুন। এধরনের চিন্তাও ডিপ্রেশনেরই একটা অংশ। এধরনের চিন্তা মাথা থেকে সরাতে পারলে ডিপ্রেশনও সরে যাবে।
- এমন কাজগুলি নিয়মিতভাবে করুন যা আপনাকে আনন্দ দেয়। পরিবারকে সময় দেওয়া, কোথাও ঘুরতে যাওয়া, খেলাধুলা করার মত কাজগুলির মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
- যখন ডিপ্রেশনের ভুগছেন তখন অবশ্যই বড় কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। কারণ যে সিদ্ধান্ত নেবেন তার ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই অনেক বেশি। আর যদি সিদ্ধান্ত নিতেই হয় তবে আপনার হয়ে এমন কাউকে সেটা নিতে বলুন যাকে আপনি বিশ্বাস করেন।
- মাদক থেকে অবশ্যই দুরে থাকুন। এটি আপনাকে ডিপ্রেশন থেকে সাময়িক দুরে রাখলেও পরবর্তীতে এটাই আপনার জন্য বিপদের মূল কারণ হয়ে দাড়াবে।
- হেরে যাবেন না যতখন সত্যি সত্যি খেলা শেষ হয়। অর্থাৎ কোন ঘটনার শেষ না দেখে হতাশ হয়ে পড়বেন না। হয়তো আপনার জন্য ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে।
আমি আশা করি, ডিপ্রেশন নিয়ে লেখা উপরের কথাগুলি আপনাদের ভালো লাগবে। কারণ এটা আমি আমার ব্যক্তিগত অনুভুতি থেকে লেখার চেষ্টা করেছি। যদি লেখাটি আপনাকে ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।
এম. এম. নবী says
বর্তমান সময়ে মানুষের আধুনিক জীবনের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি হল বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন এবং আপনি বিষয়টা নিয়ে সার্বিক আলোচনা করেছেন। সত্যই লেখাটি প্রশংসার দাবীদার।