জীবনে কোন না কোন সময় আপনাকে ব্যর্থতার মুখোমুখী হতে হবে, এটাই চলার পথের স্বাভাবিক নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী জীবনে কিছু করতে গেলে সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও আসতে পারে। এটা এমন কিছু অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয় যে, এর জন্য হতাশ হয়ে সব ফেলে রেখে দিতে হবে।
বরং, ব্যর্থতার বিপর্যয় কাটিয়ে নতুন করে সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে। খুঁজে দেখতে হবে ব্যর্থতার কারণ, বের করতে হবে ভুলগুলো। আর ব্যর্থতা থেকে শিখতে হবে শ্বাশ্বত সত্য।
ব্যর্থতা থেকে যে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখার আছে, তার মাঝে লুকিয়ে আছে দুইটি স্বাভাবিক শিক্ষা। একটি হচ্ছে আপনি হয়ত কিছু চরম ভুল করছেন, আরেকটি হচ্ছে আপনাকে ব্যর্থতা কাঁটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। এই দুইটি বিষয় মনে রাখলে একবার কিংবা দুইবার ব্যর্থ হলেও আপনি সফলতার শীর্ষে পৌঁছুতে পারবেন।
ব্যর্থতার আরেকটি বিষয়ের দিকে আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে, আমরা স্কুল কিংবা কলেজের বইয়ে অনেকে ব্যর্থতা থেকে উঠে এসে সফল হয়েছে এমন গল্প পড়েছি। কবি কালীপ্রসন্ন ঘোষের একটা প্রবাদ ছিল, ‘ একবার না পারিলে দেখো শতবার’ যা ব্যর্থতাকে জয় করার উদ্দীপনা যোগায়।
আসলে, ব্যর্থতা তো আর এমনি এমনি আসে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কিছু গ্রহণযোগ্য কারণ থাকে। যদিও ব্যক্তিভেদে সে কারণগুলো ভিন্ন রকমের হতে পারে, তবে কমোনলি যে কারণগুলোর জন্যে আমরা জীবনে ব্যর্থ হই, সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো। সেই সাথে, পাঠকরা জানবেন কিভাবে এই মারাত্বক ভুলগুলো এড়িয়ে সফল হওয়া যায়। এই লেখাটি আপনাদেরকে দেখাবো ব্যর্থতার কিছু শক্তিশালী দিক।
১. ব্যর্থতার কারণ স্ব-শৃঙ্খলার অভাব
নিজের চলাচলের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকা কিংবা জীবন-যাপনে কোনো শৃঙ্খলা না থাকাই স্ব-শৃঙ্খলার অভাব। সাফল্যের জন্য শৃঙ্খলা দরকার। সফলতার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে হলে নিজের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকা অনেক জরুরী। যাদের নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তারা অল্পতেই হাল ছেড়ে দেন।
এই অভ্যাস আপনাকে নিশ্চয়ই কোনো চুড়ান্ত সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে না। আপনাকে নিজের উপর এমন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে আগামীকালের সাফল্যের জন্য আজকে আপনি যেকোনো ত্যাগ স্বিকার করতে প্রস্তুত থাকেন।
যখন আপনি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন, তখন আপনার জন্য প্রলোভন কিংবা বিভ্রান্তি দূরে রাখা সহজ হবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ আপনার লক্ষ্যগুলোর প্রতি মনোনিবেশ রাখতে সহায়তা করবে। এতে আপনার সফলতার দিকে পৌঁছুতে বেশ সহজ হবে।
২. অধ্যবসায়ের অভাব ব্যর্থতার কারণ
আপনি অনেক মেধাবি কিংবা বুদ্ধিমান হতে পারেন, কিন্তু আপনার যদি অধ্যবসায়ের অভাব থাকে, তাহলে আপনার এই দুইটি গুন দিয়ে আদৌ কোনো আশার আলো দেখাতে পারবেন না। অধ্যবসায়ের অভাব ব্যক্তিকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দেয়। সারা পৃথিবীতে অগণিত লোক রয়েছে যারা বারবার ব্যর্থ হয়েছে শুধুমাত্র নিজেদের মেধা ও বুদ্ধির উপরে বেশি নির্ভরশীল হওয়ার কারনে।
তাই, শুধুমাত্র নিজের মেধা বা বুদ্ধির উপর নির্ভরশীল হলেই হবে না, সেই সাথে পরিশ্রম করতে হবে ও অধ্যবসায়ের অভ্যস গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই ধরা দিবে সফলতা। পৃথিবীর ৫জন সফল মানুষের সাফল্যের শিক্ষা থেকে জেনে নিতে পারেন অধ্যাবসায়ের আসল মাহাত্ম।
৩. জীবনের সঠিক উদ্দেশ্য না থাকা ব্যর্থতা বয়ে আনে
এরকম অনেক মানুষ আছে যারা জীবনে অনেক পরিশ্রম করার পরও নিজের লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারে না, শুধু মাত্র সঠিক লক্ষ্যের অভাবে। সঠিক লক্ষ্য ব্যতীত পরিশ্রম করলে কাঙ্খিত সাফল্য পাওয়া সম্ভব নয়। এতে শুধু নিজের অহেতুক কষ্ট হবে, সাথে অযথা সময়ও নষ্ট হবে।
যেকোনো কাজে নামার আগে অবশ্যই আপনাকে লক্ষ্য ঠিক করে নিতে হবে। এরপর যেভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে, সেই মোতাবেক নিজের কাজ করে যেতে হবে। তাহলেই ছোঁয়া যাবে নিজের ইচ্ছা, পৌঁছানো যাবে নিজের কাঙ্খিত লক্ষ্যে।
৪. অহেতুক যুক্তি বারবার ব্যর্থ করে দেয়
বিজয়ীরা সব সময় বিশ্লেষণ করে থাকে। অন্যদিকে যারা পরাজিত হয়, তাদের কাছে থাকে অগণিত যুক্তি। হেরে গেলে আপনার হাতে হয়তো অনেক যুক্তি থাকবে, যেসব দিয়ে আপনি বুঝাতে পারবেন কেন আপনি পারেননি। এটা একটি বদ অভ্যস।
মনে রাখতে হবে কোনো কিছু করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া মানে শেষ না। আমাদের মধ্যে অনেকে আছে যারা তাদের প্রথম চেষ্টাতেই সফল হয়েছে। কিন্তু এসব মানুষ হাতেগোনা কিছু আছে। আমরা বেশির ভাগই এমন মানুষ, যারা প্রথমবারে ব্যর্থ হই। এতে নিশ্চয়ই আপনার সাফল্যের ব্যাপারে শেষ ফলাফল নিশ্চিত হয় না। বরং আপনার হাতে সুযোগ থাকে একই কাজ অন্যভাবে করার। এভাবে এক সময় কাজটি ঠিকই হয়ে যায় বা যাবে।
তাই, হেরে যাওয়া ঢেকে দিতে যুক্তি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যুক্তি দেয়া পরাজিত মানুষের লক্ষণ।
৫. অতীতকে ভুলে যাওয়া ব্যর্থতা ঢেকে আনে
কিছু মানুষ আছে যারা শুধু পৃথিবীতে বেঁচেই থাকে না বরং কিছু শেখার চেষ্টাও করে। অন্যদিকে এমন কিছু মানুষ আছে যারা শুধু বেঁচেই থাকে। আমাদের মনোভাব সঠিক থাকলে ব্যর্থতাও আমাদের জন্য শিক্ষার একটি মাধ্যম হতে পারে। জ্ঞানী মানুষেরা তাদের অতীত ভুলগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকেন সবসময়ই।
প্রথমে অতীতের অপ্রত্যাশিভাবে ঘটে যাওয়া সমস্যাকে চিহ্নিত করতে হবে। পরিস্থিতিকে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বিশ্লেষণ করতে হবে। আপনার লক্ষ্য কী, আপনার পরিকল্পনা কী কেন সেটা কাজ করছে না এসব নিজেকে আগে জেনে নিতে হবে। পেছনের ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, অতীত মনে রাখার মতো কিছু নয়, কিন্তু অতীতকে ভুলে গেলে চলবে না, বরং সেখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
৫. ব্যর্থ হওয়ার ভয় ব্যর্থতার কারণ
যে কোনও কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হওয়ার ভয় আমাদের চিন্তা-চেতনাকে অচল করে দেয়। ব্যর্থ হওয়ার ভয়ে আমরা চেষ্টা পর্যন্ত করার ইচ্ছাশক্তি পাই না। মনে রাখতে হবে , সফলতা পাওয়ার পথে ব্যর্থ হওয়ার ভয় অন্যতম একটি বাধা। ব্যর্থতার ভয় আপনার কাজে ব্যর্থ হওয়ার থেকেও বড় ব্যর্থতা।
তাই, এই ভয় কাঁটাতে হবে। মানুষকে জীবনে কোনো না কোনো কিছু করার চেষ্টা করেই যেতে হয় জীবনভর। আমি কিংবা আপনি ঠিক জানি না, কোন কাজে আমাদের সফলতা রয়েছে। তাই ব্যর্থতার ভয় কাঁটিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এভাবেই একদিন ধরা দিবে সফলতা।
দ্রুত সাফল্য চাওয়া ব্যর্থ করে দেয়
আমরা অনেকেই জীবনে দারুণ কিছু করতে চাই। এর জন্য নিজেদেরকে বিভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির মুখোমুখী দাঁড় করাই। কিন্তু যখন বুঝতে পারি আমাদের অনেক কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, তখনই হাল ছেড়ে দিতে চাই। আমরা ঐ রকম লোকজনের মতোই, যারা এক ঘন্টা পাহাড়ে উঠার চেষ্টা করে যাতে রাস্তা ছোট হয়ে আসে। যখন দেখি রাস্তা আর ছোট হচ্ছে না, বরং পরিশ্রম করেই যেতে হবে; তখনই হাল ছেড়ে দেই।
সাথেসাথে ফলাফল পাওয়ার ইচ্ছা একটা মানসিক প্রবনতা, যেটা খুবই স্বাভাবিক। তাই, আপনার উৎসাহকে ধরে রাখার জন্য লক্ষ্যকে ছোট ছোট লক্ষ্যে বানিয়ে নিন। এতে আপনার দীর্ঘ পরিশ্রমে কোনো কষ্ট হবে না। কারণ, আপনার অবচেতন মন আপনাকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
বিনয়ের অভাব ব্যর্থতার কারণ
সফলতার জন্য বিনয় খুব জনপ্রিয় ব্যাপার না হলেও অনেক ব্যক্তিরা মনে করেন সফলতার জন্য বিনয় অন্যতম একটি বিষয়। একটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে, বিনয়ী লোকেরা ভাল পারফর্মার হয়ে থাকেন। মানসিকভাবেও এটি একটি উত্তম গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিনয় আপনার শক্তি, দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতাগুলোকে সামনে এনে সেসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে সহায়তা করবে যা আপনি নাও জেনে থাকতে পারেন। এতে নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সুযোগ পাবেন যা আপনাকে সফলতার পথে এগিয়ে নিবে। আসলে, বিনয় মানুষকে ভীষণভাবে অন্যদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। ফলে, অন্যান্য মানুষ তার সফলতার ক্ষেত্রে সহযোগী হয়।
নিজের প্রতি বিশ্বাস না থাকা ব্যর্থ করে দেয় অনেককে
সফল ও অসফল মানুষের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য হচ্ছে নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকা এবং না থাকা। সফল ব্যক্তিরা বুঝতে পারে তাদের কাজ তারা অবশ্যই করতে পারবে। একবারে না পারলেও বারবার চেষ্টা করে একটা ফলাফল বের না হওয়া পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে।
তাই, আমাদের মনে রাখতে হবে, নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকা সফল হওয়ার অন্যতম পাথেয়।
নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব ব্যর্থতার কারণ
তাদের জন্য সাফল্য পাওয়া অনেক কঠিন যারা অন্যকে নিজেদের নেতিবাচক ব্যক্তিত্ব দিয়ে প্রভাবিত করে। সফলতা আসে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এবং শক্তি আসে শক্তিশালি ব্যক্তিত্ব থেকে। তাই, সফল ব্যক্তি হতে হলে এই বদগুণ এখনই ত্যাগ করতে হবে।
উপরোক্ত ১০টি ছাড়াও জীবনে ব্যর্থ হওয়ার আরো অনেক কারণ আছে যা বিভিন্ন মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। তবে, যেমনই হোক না কেন, আমাদের অবশ্যই উপরে উল্লেখিত ভুলগুলো পরিহার করতে হবে। সফলতার জন্যে ব্যর্থতার কারণগুলো থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
Leave a Reply