ঘুমের জন্যে ভিটামিন প্রয়োজন। কারণ, এমন অনেকেই আছেন যারা ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। রাত বেড়ে গেলেও তাঁদের চোখে ঘুম আসতে চায় না, শুধু এপাশ ওপাশ করেই সময় যায়। বিশেষ করে চাকরিজীবী যারা তাঁদের এক্ষেত্রে মহা সমস্যা। পরদিন সকালে ঠিকই সাতটায় উঠে অফিসে যেতেই হয়। এদিকে সারা রাত ঘুম না হওয়ায় মেজাজটা থাকে খিটখিটে, কাজে মন বসতে চায় না।
আপনি হয়তো জানেন না যে শরীরে প্রয়োজনীয় কিছু ভিটামিনের অভাবই আপনার এই ঘুমহীণতার কারণ। কিছু ভিটামিন ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান ঘুম আসতে ও সঠিকভাবে ঘুমের চক্র পূর্ণ করতে সাহায্য করে। কারো শরীরে সেগুলোর অভাব ঘটলে নিয়মিত ঘুমের প্রক্রিয়ায় বাধা পড়ে।
এছাড়া আমাদের কারো কারো এমন কিছু অভ্যেশ আছে যেগুলো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। যেমন, স্মার্টফোনের কাছাকাছি ঘুমানো একটি ক্ষতিকর অভ্যাশ যা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘুম না হওয়ার অন্যতম কারণ। তবু, বিশেষ কিছু ভিটামিন গ্রহণের মাধ্যমে ঘুমহীনতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। চলুন তাহলে জেনে নিই কি কি ভিটামিন আপনার ঘুমের অভাব দূর করতে সাহায্য করবে।
পরিমিত ঘুমের জন্যে ভিটামিন
খুব বেশি ঘুম কিংবা খুব কম ঘুমের কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। তাই, প্রয়োজন পরিমিত ঘুম। আর পরিমিত ঘুম বা ভাল ঘুমের জন্যে প্রয়োজন কিছু নির্দিষ্ট্য ভিটামিন। সেই ভিটামিনগুলো নিয়েই আমাদের আজকের হেলথ্ হ্যাক এর আয়োজন। আসুন জেনে নেই ভিটামিনগুলো কি কি…
১। ভিটামিন ডি
গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন ডি এর পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ঘুমের গভীরতা ও সময় দুটোর ওপরই এতে সরাসরি প্রভাব পড়ে। এছাড়াও ভিটামিন ডি শরীরের প্রদাহ ও ব্যথা কমায়, এ কারণেও এই উপাদানটির অভাবে ঘুমে বাধা আসতে পারে।
ভিটামিন ডি এর উৎসঃ সূর্যের আলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি থাকে। বিশেষ করে ভোরবেলার নরম রোদটা খুব উপকারী। তাই কষ্ট করে হলেও সকাল সকাল ওঠার চেষ্টা করুন। দিনে অন্তত ১৫ মিনিট রোদ পোহাতে হবে। এছাড়া তেলযুক্ত মাছ, ডিমের কুসুম ইত্যাদিতেও ভিটামিন ডি থাকে। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসারে সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন।
২। ভিটামিন সি
শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী এই ভিটামিন ঘুম আনতেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। অনেক সময় দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের জন্য ঘুম আসে না। ভিটামিন সি দুশ্চিন্তার ফলে তৈরি হওয়া করটিসল হরমোনকে দ্রুত শরীর থেকে বের করে দিতে সাহায্য করে। এ কারণে দীর্ঘস্থায়ী ঘুমের সমস্যার চিকিৎসায় ইদানীং ভিটামিন সি ব্যাবহার হয়।
ভিটামিন সি এর উৎসঃ টক জাতীয় প্রায় সব ফলে ভিটামিন সি পাওয়া যায়। দামী বিদেশি ফল যেমন কমলা, কিউই ইত্যাদির কথা বাদ দিলেও আমাদের সাধারণ দেশী ফলেই ভিটামিন সি-র প্রাচুর্য। আমলকি, কামরাঙ্গা, পেয়ারা, চম্পা কলা, আম, আমড়া ইত্যাদি ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি পাবেন।
৩। আয়রন
অনেকে রাতের বেলা পায়ে বা কোমরে এক ধরনের অস্বস্তিকর, ছটফটে অনুভূতির শিকার হন। একে বলে “রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম”। এই অসুবিধায় আক্রান্তরা নিজেরাও ঘুমাতে পারেন না, উলটো তাদের পা ছোঁড়াছুঁড়িতে অনেক সময় অন্যদের ঘুমও ভেঙে যায়। এই সমস্যাটা ঘটে আয়রনের অভাবের কারণে। তাই খাবারের তালিকায় এই খনিজ পদার্থটি বেশি করে রাখুন।
আয়রণ এর উৎসঃ সবুজ শাক সবজি, কলিজা, বাদাম, মাংস, সিমের বিচি ইত্যাদি।
৪। মেলাটোনিন
মেলাটোনিন একটি “স্লিপ হরমোন”। রাতের বেলা মানুষের শরীরে উৎপন্ন হয় বলে একে “অন্ধকারের হরমোন”-ও বলে। সঠিক সময়ে ঘুম আসা ও ভাঙ্গানোর দায়িত্ব এই হরমোনটির। এই হরমোন ঠিক মত কাজ না করলেও আপনার ঘুমের চক্রে বাধা পড়তে পারে।
মেলাটোনিন এর উৎসঃ আনারস, আদা, আখরোট, টক চেরি ফল ইত্যাদির মধ্যে অল্প পরিমাণে মেলাটোনিন থাকে। কাজেই ঘুমের সমস্যায় এগুলো খেতে পারেন। এছাড়া ডাক্তার প্রয়োজন মনে করলে মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্ট দেবেন।
৫। ট্রিপ্টোফ্যান
এমাইনো এসিড দিয়ে আমাদের শরীর প্রোটিন গঠন করে, এবং বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সংকেত পাঠায়। এল-ট্রিপ্টোফ্যান এমনই একটি অতি প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড। ট্রিপ্টোফ্যান শরীরে ঘুমের সঙ্কেতটি পাঠানোর কাজে নিয়োজিত উপাদানগুলো তৈরি করতে সহায়তা করে।
কিন্তু শরীরে ট্রিপ্টোফ্যান নিজে থেকে তৈরি হয় না। তাই আমাদের খাবার থেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি সংগ্রহ করতে হবে।
ট্রিপ্টোফ্যান এর উৎসঃ ডিম, মুরগী ও হাঁসের মাংস, এবং বিশেষ করে মিষ্টি আলুতে প্রচুর পরিমাণে ট্রিপ্টোফ্যান পাওয়া যায়। এছাড়া দুধেও ট্রিপ্টোফ্যান থাকে। এ জন্যেই অনেকে ঘুমের আগে এক গ্লাস হালকা গরম দুধ খেতে পরামর্শ দেন।
৬। ভিটামিন বি কমপ্লেক্স
ভিটামিন বি শরীরে প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড, যেমন ট্রিপ্টোফ্যান তৈরি করে। এছাড়াও ভিটামিন বি দেহের স্নায়ুতন্ত্র ও রক্তকণিকা গঠন করতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে যাদের খাবারে ভিটামিন বি, বিশেষ করে বি ১২ এর অভাব রয়েছে, তাদের মধ্যে অতিরিক্ত ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা ও খিটখিটে ভাব দেখা দেয়। ঘুমের জন্যে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স তাই অত্যন্ত উপকারী।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এর উৎসঃ দেখে নিন ভিটামিন বি কমপ্লেক্স পাবেন যে ১০টি খাবারে।
৭। ম্যাগনেসিয়াম
শরীরে ঘুমের হরমোন, মেলাটোনিন তৈরি করতে সাহায্য করে এই খনিজ উপাদানটি। এছাড়াও ম্যাগনেসিয়াম মাংসপেশির আড়ষ্টতা দূর করে, ফলে ঘুম ভাল হয়।
ম্যাগনেসিয়াম এর উৎসঃ সবুজ শাক সবজি, কুমড়ার বিচি, স্পিরুলিনা এবং বাদামের মধ্যে প্রচুর ম্যাগনেসিয়াম মেলে। এছাড়া ডাক্তারের পরামর্শ মত সাপ্লিমেন্ট খেতে পারেন। কিন্তু এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে, কারণ কিডনি সমস্যা বা হার্টের গতি খুব ধীর হলে ম্যাগনেসিয়াম এড়িয়ে চলতে হবে।
৮। পটাশিয়াম
গবেষণায় দেখা গেছে যে পটাশিয়াম ঘুমের গভীর স্তরে যেতে সাহায্য করে। সহজেই যাদের ঘুম ভেঙে যায় তারা পটাশিয়াম যুক্ত খাবারের ওপর জোর দিতে পারেন।
পটাশিয়াম এর উৎসঃ কলা, স্যামন মাছ, সবুজ শাক সবজি, সিমের বিচি, তরমুজ, দই, টমাটো, মিষ্টি আলু ইত্যাদি।
৯। ক্যালসিয়াম
আয়রনের মতই ক্যালসিয়ামও সরাসরি ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। ঘুমের মধ্যে আমরা যখন স্বপ্ন দেখি, তাকে বলা হয় “রেম” ঘুম (Rapid Eye Movement)। শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব থাকলে এই রেম ঘুমে বাধা পড়ে। ফলে মানুষ শ্রান্তি অনুভব করে।
প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে অন্তত ১০০০ মিঃ গ্রাঃ ক্যালসিয়াম খাওয়া উচিত।
ক্যালসিয়াম এর উৎসঃ দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার ক্যালসিয়ামের বড় উৎস। এছাড়া সবুজ শাক সবজি, তিল ইত্যাদি বেশি করে খেতে পারেন।
১০। ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড
শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় “ভাল চর্বি” হল ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড। এই এসিড শরীরের ভেতর ভেঙে এমন কিছু উপাদান তৈরিতে সাহায্য করে যেগুলো ঘুম আসার জন্য অত্যন্ত জরুরী, যেমন মেলাটোনিন।
ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড এর উৎসঃ সামুদ্রিক মাছ ও সিফুড; যেমন চিংড়ি, তিসির বীজ ও তেল, আখরোট, ডিম, বুনো চাল (যেমন কাউন), দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য ইত্যাদি।
আধুনিক গবেষণায় পাওয়া তথ্য অনুসারে, ঘুমের জন্যে ভিটামিন এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আপনি যদি এই সমস্যার শিকার হয়ে থাকেন, ঘুমের ওষুধ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। ঘুমের ওষুধ শুধু যে স্বাভাবিক ঘুমের প্যাটার্ন নষ্ট করে দেয় তাই নয়, এর কারণে আপনি বিষণ্ণতার শিকারও হতে পারেন। তার বদলে আপনার খাবারে যুক্ত করুন এই প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খাদ্য উপাদানগুলো।
Leave a Reply