আমাদের শরীরে খনিজ পদার্থ গুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ক্যালসিয়াম। দাঁত ও হাড়ের গঠনে ক্যালসিয়াম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই, আমাদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার এর কোনও বিকল্প নেই।
ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় ও দাঁতে ক্ষয় এবং স্নায়ু, হৃদস্পন্দন ও মাংস পেশীতে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় হাড় ক্ষয় বেশি হলে অস্টিওপোরোসিসের মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে। এছাড়াও ক্যালসিয়ামের অভাবে খিঁচুনি, জয়েন্ট ব্যাথা, হাত-পা ব্যাথা, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
ক্যালসিয়ামের অভাবে সৃষ্ট সমস্যা যে শুধু বৃদ্ধদের হয় তা নয়, অনেকের অল্প বয়সেই এ-সব সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই, ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণ করতে আমরা প্রায়ই ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খেয়ে থাকি। কিন্তু অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম গ্রহণও আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম কিডনিতে পাথর সৃষ্টি করতে পারে।
তাহলে, ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত সমস্যাগুলো থেকে বাঁচার উপায় কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যালসিয়াম ঘাটতিজনিত রোগ থেকে বাঁচতে হলে যে-সব খাবারে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম আছে, অল্প বয়স থেকেই সেগুলো খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
সাধারণত বয়স ও প্রয়োজন অনুযায়ী আমাদের দেহে প্রতিদিন ৬০০-১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। বিশেষ করে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের দৈনিক ১০০০ কিলোগ্রাম ক্যালসিয়াম গ্রহণ করা প্রয়োজন।
শরীরে ক্যালসিয়ামের অভাব দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ খাবারগুলো গ্রহণ করতে হবে। তাহলে, চলুন জেনে আসি ক্যালসিয়াম যুক্ত ৯টি খাবার সম্পর্কে যেগুলোকে খাদ্য বিশারদরা সুপারফুড বলে থাকেন। এছাড়াও, সামগ্রিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ৮টি উপকারী সুপারফুড সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন।
ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার
১. বীজে আছে বিপুল পরিমাণে ক্যালসিয়াম
বীজ জাতীয় খাবারকে ক্ষুদ্র পুষ্টির পাওয়ার হাউস বলা হয়। বিভিন্ন ধরণের বীজে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় যা আমাদের দেহ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বীজ জাতীয় খাবার হিসেবে সচরাচর যেগুলো পাওয়া যায়, সেগুলো হলো-
- পোস্ত
- তিল
- সেলারি
- চিয়া, ইত্যাদি।
এগুলোই মূলত বীজ জাতীয় খাবারের উদাহরণ।
১ টেবিল চামচ পোস্ত বীজে ১২৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম রয়েছে এবং ১ টেবিল চামচ তিলের বীজে ক্যালসিয়াম রয়েছে ৯ গ্রাম। এছাড়াও বীজগুলিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন এবং স্বাস্থ্যকর চর্বি।
২. ক্যালসিয়ামসহ বাদাম বহু পুষ্টি গুণ আছে
বাদামের পুষ্টিগুণ এবং শরীরিক উপকারিতা অনেক। নিয়মিত বাদাম খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কারণ, বাদামে এমন অনেক উপাদান রয়েছে যেগুলো বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
বাদামে যে-সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে-
- প্রোটিন
- ক্যালসিয়াম
- ভিটামিন ই
- ফাইবার
- সেলেনিয়াম
- ভিটামিন সি
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
- অ্যামাইনো অ্যাসিড
- পটাশিয়াম, ইত্যাদি।
এ-সব উপাদান আমাদের দেহ গঠনে মূখ্য ভূমিকা রাখে।
বাদামে থাকা ক্যালসিয়াম আমাদের হাড়ের গঠনকে মজবুত করে এবং বাদামে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের ব্রেনের শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তাছাড়া বাদামের বিপুল অ্যাক্সিডেটিভ আমাদের ত্বকের বয়স ধরে রাখতে সাহায্য করে।
নিয়মিত বাদাম খেলে আমাদের হার্ট সুস্থ্য থাকে।
তাই, বাদামের উপকারিতা বিবেচনা করে প্রতি দিনের খাদ্য তালিকায় নির্দিষ্ট পরিমাণ বাদাম রাখার চেষ্টা করুন।
৩. ক্যালসিয়ামের মহা উৎস মসুর ডাল
মসুর ডাল প্রায় সবারই পছন্দের খাবার। কিন্তু ডাল খেতে আপনি পছন্দ না করলেও ডালের পুষ্টিগুণ বিবেচনা করে আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ডাল রাখতে পারেন। মসুর ডালে রয়েছে ক্যালসিয়াম যা আমাদের দেহ গঠনে সাহায্য করে।
ডালে ক্যালসিয়াম ছাড়াও আরো যে-সব গুরুত্বপূর্ণ উপাদার রয়েছে, সেগুলো হলো-
- আয়রন
- দস্তা
- ফোলেট
- ম্যাগনেসিয়াম
- পটাসিয়াম, ইত্যাদি।
নিয়মিত ডাল খাওয়ার ফলে আপনার শরীরের রক্ত সঞ্চারণ বৃদ্ধি পায়। ডাল হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি কমাতেও সাহায্য করে। নিয়মিত ডাল খেলে শরীরের চিনির পরিমাণ কমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করবে। ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার হিসেবে ডাল তাই অনেকের জন্যেই আদর্শ।
৪. দই ক্যালসিয়ামের দারুণ উৎস
দইকে বলা হয় খাদ্যপ্রাণ। ক্যালসিয়ামের একটি দুর্দান্ত উৎস হচ্ছে দই। এছাড়াও দই প্রোবায়োটিক ব্যাকটিরিয়া সমৃদ্ধ যা আমাদের সুস্বাস্থ্য গঠনের প্রয়োজনীয় উপাদান। গবেষকদের মতে ২৪৫ গ্রাম দইতে ক্যালসিয়ামের ৩০% আরডিআই রয়েছে।
এছাড়াও দইয়ে আরো আছে-
- ফসফরাস
- পটাসিয়াম
- ভিটামিন বি ২
- ভিটামিন বি ১২
আপনি যদি নিয়মিত দই খান, তাহলে দইয়ে থাকা ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি আপনার হারকে মজবুত করবে। দই আপনার রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। এটি আপনার হজমের সমস্যা দূর করবে। আপনার ওজন কমাতেও সাহায্য করবে। তাই, সুস্থ্য থাকতে হলে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় দই রাখা উচিত।
৫. পনির প্রচুর ক্যালসিয়াম
দুগ্ধজাত খাবারের মধ্যে ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার হচ্ছে পনির। বিভিন্ন জাতের পনিরের মধ্যে হলুদ রঙের পনিরে ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
পনিরে আরো আছে-
- ফসফরাস
- জিংক
- ভিটামিন এ
- ভিটামিন বি ১২
নিয়মিত পনির খেলে পনিরে থাকা পটাশিয়াম আমাদের ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে। এটি আমাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ করবে। এছাড়াও, পনির শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করবে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও হ্রাস করবে।
শরীরের ক্যালসিয়মের ঘাটতিজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে নিয়মিত পনির খেতে পারেন।
৬. পাতাযুক্ত শাকসবজি
শাকসবজির মধ্যে বিশেষ করে পাতাযুক্ত শাকসবজিগুলোতে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে। আমাদের প্রায় সবারই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শাকসবজি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর এটি ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার হিসেবে আমাদের জন্যে অপরিহার্য্য।
সাধারণত যে-সব শাকসবজিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়-
- কলার্ড গ্রিন
- পালং শাক
- সরষে শাক
- নটে শাক
- বাঁধাকপি
- ব্রকোলি
- ফুলকপি, ইত্যাদি।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯০ গ্রাম রান্না করা কলার্ড গ্রিনের ২৬৬ মিলিগ্রাম ক্যালমিয়াম রয়েছে যা আমাদের এক দিনে এক চতুর্থাংশ ক্যালসিয়ামের অভাব পূরণ করে।
এছাড়াও, করলা ও পাটশাক খাবারে রুচি বৃদ্ধি করে এবং দেহের মেদ কমাতে সাহায্য করে। আবার ধনেপাতা ও পুদিনাপাতা ছাড়াও গাঢ় সবুজ ও হলুদ শাক-সবজি আমাদের রাতকানা রোগ দূর করে, হাঁড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করে এবং স্নায়ুবিক অসুস্থতা দূর করে।
বিশেষ করে পালংশাক, বাঁধাকপি, ফুলকপি দেহের রক্ত সঞ্চারণ বৃদ্ধি করে। আমাদের শরীরের রক্তস্বল্পতা দূর করতে কচুর শাক, লালশাক, পালংশাক, বিট, লেটুসপাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৭. দুধ ক্যালসিয়ামের দারুণ উৎস
দুধ শুধু ক্যালসিয়ামের উৎসই নয়, এটি হচ্ছে সর্বগুণ সম্পন্ন খাবার। যার ফলে, দুধকে সুপার ফুড বলা হয়। আমাদের দেহ গঠনের জন্য পুষ্টিকর খাবারের মধ্যে দুধ অন্যতম। এটি আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে দেহকে রোগ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের মধ্যে যেগুলোর প্রধান উৎস হচ্ছে দুধ, সেগুলো হল-
- ক্যালসিয়াম
- প্রোটিন
- ভিটামিন ১২
- পটাশিয়াম
- ফসফরাস, ইত্যাদি
দুধে থাকা ক্যালসিয়াম আমাদের দাঁত ও হাড়কে মজবুত করে। আমাদের পেশিকেও শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
দুধে থাকা ভিটামিন ও মিনারেল আমাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। ভাল ঘুমের জন্য যে-সব ভিটামিন প্রয়োজন, তার অনেকগুলোই দুধের মধ্যে পাওয়া যায়। ফলে, নিয়মিত দুধ পানের ফলে ভালো ঘুম হয় যা আমাদের মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে।
এছাড়াও আপনার যদি ডিহাইড্রেশনের সমস্যা থাকে, তাহলে নিয়মিত দুধ পানের মাধ্যমে এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
দুধে থাকা পুষ্টি উপাদান আমাদের দেহের কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে, কোলেস্টোরল নিয়ন্ত্রণে রাখে, রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে, ডায়াবেটিকসের ঝুঁকি হ্রাস করে, দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তাই, প্রতিদিন ১ গ্লাস দুধ পান করার চেষ্টা করুন।
৮. সামুদ্রিক মাছে ক্যালসিয়াম আছে
সামুদ্রিক মাছগুলো উচ্চ-মানের প্রোটিন এবং ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সরবরাহ করে যা আপনার হার্ট, মস্তিষ্ক এবং ত্বকের জন্য উপকারী। বিশেষ করে, তৈলাক্ত মাছে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই, ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার হিসেবে সম্ভব হলে প্রায়ই তৈলাক্ত মাছ খেতে পারেন।
৯. শুকনো ফলে প্রচুর ক্যালসিয়াম
নিয়মিত শুকনো ফল খেলে আপনার দেহের ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ হতে পারে। তাই, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় শুকনো ফল রাখার চেষ্টা করুন।
যে-সব শুকনো ফলে ক্যালসিয়ামেরর পরিমাণ বেশি থাকে-
- এপ্রিকট
- খেজুর
- বাদাম, ইত্যাদি।
তবে, অতিরিক্ত বাদাম, খেজুর গ্রহণে আপনার দেহের ওজন বৃদ্ধি পেতে পারে। এজন্য পরিমাণমতো শুকনো ফল গ্রহণ করুন।
আপনি নিশ্চয় এতক্ষণে জেনে গেছেন ক্যালসিয়াম আমাদের দেহের জন্য কতটা প্রয়োজন। আমাদের সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিদিন পরিমাণমতো ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত। যদি কখনো ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত সমস্যা বেশি দেখা দেয়, তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। সুস্থ জীবন নিশ্চিত করুন।
Leave a Reply