আপনি কি আপনার সন্তানের মিথ্যা বলা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন? সন্তানের মিথ্যা কথা আপনাকে হতাশ করছে? সন্তানের মিথ্যা বলা নিয়ে যারা দুশ্চিন্তায় আছেন, আজকে তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই আমার এই লেখা। পুরো আর্টিকেল জুড়েই আপনার এমন সব পরামর্শ থাকবে যার মাধ্যমে সহজেই সন্তানকে মিথ্যা বলা থেকে ফেরাতে পারবেন।
আমরা জানি, শিশুরা অনুকরণ প্রিয় আর এই অনুকরণ করতে গিয়েই অনেক সময় দেখা যায় তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়। কোন পিতা-মাতাই চাইবে না তার সন্তান মিথ্যা কথা বলুক। কিন্তু সামাজিকীরণের কারণে অনেক সময় আপনার সন্তান সত্যের চেয়ে মিথ্যাকেই অধিক প্রাধান্য দিতে শুরু করে।
তাই চলুন জেনে নেয়া যাক কীভাবে সন্তানকে মিথ্যা কথা বলা থেকে ফেরাবেন ও সত্য কথা বলা শেখাবেন তা সম্পর্কে বিস্তারিত।
যেভাবে সন্তানকে মিথ্যা বলা থেকে ফেরাবেন
নিজেরা সত্য বলুন
আপনার সন্তানকে মিথ্যা কথা বলা থেকে ফিরিয়ে আনতে প্রথমেই প্রয়োজন পরিবারের সবাইকে সত্য কথা বলা। কারণ, আপনাকে দেখেই আপনার সন্তান শিখবে৷ যদি পরিবারের কর্তারাই মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তবে শিশুটিও যে মিথ্যা বলবে না তার কোন গ্যারান্টি নেই।
তাই, পরিবারের সবারই এই ব্যাপারে সর্বদা সর্তক থাকা উচিত। সন্তানের সামনে এমন কিছু বলবেন না, যা তাকে মিথ্যা কথা বলতে প্রলুব্ধ করে। তাই সর্বদা এই বিষয়ে সতর্ক থাকবেন।
নীতি বাক্য শেখান
শিশুরা কখনো সত্য এবং মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। তাদেরকে এই সময় যা শিক্ষা দেয়া হয়, তারাও তাই শিখে। চেষ্টা করুন সব সময় শিশুকে নীতিবাক্য শেখানোর। যেমন, মিথ্যা বলা মহাপাপ কিংবা ঈশপের কোন গল্প যেখানে মিথ্যাবাদীকে খারাপ হিসাবে দেখানো হয়।
এছাড়াও শিশুকে ভাল এবং খারাপের মধ্যে পার্থক্য ধরিয়ে দিতে পারেন। যেমন “এই শার্টটা ঠিক না, এই শার্টটা ঠিক এভাবে” কিংবা “এভাবে কথাটা না বলে তুমি এভাবে বলতে পারো, তাহলে সবাই তোমার কথা পছন্দ করবে” এই টাইপ কথা বলতে পারেন। এছাড়া, রাজার নতুন কাপড়ের গল্প কিংবা বালকের মিথ্যা বাঘের গল্পটিও শোনাতে পারেন।
শিক্ষামূলক পড়া ও খেলায় ব্যস্ত করে দিন
শিশুরা বেশিরভাগ সময়ই মিথ্যা বলা শেখে অন্য শিশুদের কাছ থেকে। যদি বাইরে খেলাধূলা করা বা অন্যদের সঙ্গে মিশতে দেয়া অনেক ক্ষেত্রেই ভাল, তবু আপনি খেয়াল করে দেখবেন যে আপনার সন্তানটি অন্যদের সঙ্গে খেলার থেকেও বেশি আনন্দ পায় মোবাইলে গেম খেলে।
তাই আপনার সন্তানকে শিক্ষামূলক অ্যাপ ও গেমস্ খেলতে দিন। এতে করে সে সাধারণত যে-সব কাজে মিথ্যা বলে থাকে, সেগুলো থেকে একদিকে যেমন দূরে থাকবে, অন্যদিকে অনেক কিছু শিখতে পারবে। তাছাড়া, এই ধরণের অ্যাপ বা গেম তার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায়ও কাজে লাগবে। যেমন, ছোটদের জন্য প্রচুর অংক শেখার অ্যাপ রয়েছে। তার যদি নিজস্ব ট্যাব থাকে, তবে সেটিতে ডাউন করে দিন আর না থাকলে আপনার মোবাইলেই ডাউনলোড করে নিন।
ছোটরা ছবি আঁকতে খুব ভালবাসে, সেই সাথে এটি তাদের স্কুলের সিলেবাসেও থাকে। তাই আপনার সন্তানকে মিথ্যা বলা থেকে বিরত রাখতে ছবি আঁকা শেখার অ্যাপ ও গেম খেলতে দিয়ে ব্যস্ত রাখুন। দেখবেন, সারাদিন সে এগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। দুষ্টুমি করার সুযোগ পাবে কম আর সেই দুষ্টুমির জন্যে মিথ্যে বলারও আর প্রয়োজন হবে না।
মিথ্যা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করুন
কোন বস্তুকে মিথ্যা বলার কারণ যদি শিশুকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলেন, তাহলে তার জন্য বুঝতে সুবিধা হয়। ধরুন, সে আবদার করে বসল যে সে চাঁদ হতে চায়, এখন তাকে জিজ্ঞেস করুন বাস্তবে কি চাঁদ হওয়া সম্ভব কিনা। এভাবে শিশুর প্রশ্নের উত্তর দিন যাতে সে কনফিউশনে না থাকে।
শিশুর প্রশ্নকে কখনো এড়িয়ে যাবেন না, কখনো ছোট করে দেখবেন না। কারণ শিশুকাল থেকে শিখে আসা প্রত্যেকটা বিষয়েই একেবারে মনের মধ্যে বসে যায়। ছোটবেলায় শেখা মিথ্যা কথাটিই তার কাছে সত্য মনে হবে। তার জীবনের সকল কাজে কর্মে ছোটবেলা থেকে শেখা জ্ঞান প্রতিফলিত হবে। তাই সন্তানকে মিথ্যা এবং সত্যের মধ্যে পার্থক্য করতে শেখান।
সন্তানকে সুযোগ দিন
আপনার সন্তান যখন মিথ্যা কথা বলবে, তখন তাকে ভয় না দেখিয়ে তার পাশে দাঁড়ান। তাকে একবার সত্য বলার সুযোগ দিন। তাকে বলুন “আমি তোমাকে আরেকবার সুযোগ দিচ্ছি, তুমি সত্য করে বল।” দেখবেন সে আপনাকে সত্য কথা বলবে। এভাবে সত্য কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
সাইকোলজিতে একটা কথা আছে, যে ব্যক্তি কোন কাজ একটানা একুশ দিন নিয়মিত করে কিংবা কোন কাজ থেকে একুশ দিন দূরে থাকে, সে ব্যক্তি ঐ কাজকে নিজের অভ্যাসে পরিনত করে তোলে। কিংবা সে অভ্যাস আজীবনের জন্য ত্যাগ করে। তাই সন্তানকে একটানা একুশ দিন মিথ্যা বলা থেকে দূরে রাখুন, দেখবেন আপনার শিশু মিথ্যা বলা ছেড়ে দিয়েছে।
সত্য বলার জন্য পুরস্কৃত করুন
শিশুরা সব সময় ভালাবাসা আর একটু স্নেহ মমতা খোঁজে। তাই সন্তানকে সত্যের পথে আনতে চাইলে ভয় না দেখিয়ে তাকে আদর আর স্নেহ দিয়ে বোঝান। কঠোর না হয়ে কোমলভাবেই তাকে মিথ্যা থেকে দূরে রাখুন। এজন্য আপনি একটা কাজ করতে পারেন সন্তানের প্রত্যেকটা সত্য বলার জন্য তাকে পুরস্কৃত করুন। তাকে বলুন সত্য কথা বললে পুরস্কার দিব।
এতে করে আপনার সত্য কথা বলার প্রতি আপনার সন্তানের আগ্রহ কয়েকগুন বেড়ে যাবে। তাহলেই দেখবেন আপনার সন্তানও আপনার কথায় রাজি হয়ে মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকবে।
মিথ্যা বলার কুফল বলুন
আমরা জানি ন্যাচারালি মিথ্যা কথা বলার পরিনাম খুব খারাপ হয়। আর এই কথাটাই আপনার শিশুকে বলুন। মিথ্যা কীভাবে মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে আর সত্য কথা বলার সম্মান কতটা বেশি তা অনুভব করাতে শেখান।
এমন সব গল্প কিংবা সত্য ঘটনা তার কাছে উপস্থাপন করুন যা তার সত্য বলার উৎসাহকে কয়েকগুণে বাড়িয়ে তোলে।
ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকুন
আপনি যদি আপনার সন্তানকে ভয় দেখিয়ে সত্য কথা বলাতে চান, তাহলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তাই শিশুকে সব সময় স্নেহের সাথে সত্য বলতে শেখান।
ভয় দেখালে সন্তান আপনার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। তাই ভয় না দেখিয়ে সন্তানকে স্নেহ আর ভালবাসায় সত্য বলার অভ্যাস করুন।
অনুতপ্তবোধ শেখান
যদি কখনো আপনার সন্তান মিথ্যা কথা বলে, তাহলে তাকে তার কাজের জন্য অনুতপ্ত হতে শেখান। এতে করে সন্তান বুঝতে পারবে মিথ্যা বলা কতটা খারাপ হতে পারে। একদিকে যেমন সত্য কথা বলার পুরস্কার, তেমনি মিথ্যা কথা বলার পরিনাম কি হতে পারে সে বিষয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন।
সন্তানকে সময় দিন
বেশিরভাগ অভিভাবককেই এই ভুলটি করতে দেখা যায়। সন্তানকে সময় না দেয়ার কারণে অনেক সময় সে উল্টো দিকেই চলতে শুরু করে। এতে করে সন্তান বিপদগামী হতে পারে। তাই সকল অভিভাবকের উচিত তার সন্তানকে সময় দেয়া।
এতে করে সন্তান মা-বাবার কাছ থেকে ভাল কিছু শিখতে পারবে। সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই তার ভবিষ্যতকে আরও বেশি উজ্জ্বল করতে পারে।
শিক্ষামূলক চলচিত্র প্রদর্শন
এটি সবচেয়ে কার্যকরী ও দূর্দান্ত একটি উপায়। যে কথাটি আপনার পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না, সে কথাটিই আপনি খুব সহজেই আপনার সন্তানকে শিক্ষামূলক চলচিত্র দেখিয়ে শেখাতে পারেন। এতে শিশু খুব দ্রুত অনুভব করতে শিখবে এবং মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকবে।
আশাকরি উপরে আলোচনা করা প্রত্যেকটা উপায় আপনার সন্তানকে মিথ্যা বলা থেকে ফেরাতে ও সত্য বলা শেখাতে আপনাকে সাহায্য করবে। যদি আপনি মনে করেন যে, সব বাবা-মায়েরই এই কথাগুলো জানা উচিৎ, তবে এই লেখাটি শেয়ার করে আপনার মতো অন্যান্য সকল বাবা-মাকেও জানিয়ে দিন।
Leave a Reply