এসি ব্যবহার করলে এসি বিস্ফোরণের কারণ জেনে রাখা আবশ্যক। কেননা, প্রায়ই আমাদের দেশে এসি বিস্ফোরণে মানুষ মারা যায়, কিংবা বড় ধরণের হতাহতের খবর পাওয়া যায়।
গ্রীষ্মকালের শুরুতেই আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে জিনিসটির কথা সবার আগে মনে পড়ে তা হল এসি। “উফ আজ বড্ড গরম! এসিটা ছাড়া চলবেই না”- এই কথাটি খুব সাধারণ। তাপমাত্রা ইদানীং যেভাবে বাড়ছে, তা ক্রমাগতই সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আর তার সমাধান হিসেবে অনেক আগে থেকেই এসি জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তবে, এর ব্যবহারও হওয়া চাই সঠিক এবং সুষ্ঠু। তা না হলে এই এসিই হতে পারে মৃত্যুর কারণ।
এসির সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে আমরা অনেকেই উদাসীন। এজন্যই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে অনেকেই এসি বিস্ফোরণের মত বিপদের সম্মুখীন হয়ে থাকেন। আসুন, জেনে নেয়া যাক এসি বিস্ফোরণের সেই কারণসমূহ-
এসি বিস্ফোরণের কারণ
১. নিম্নমানের এসি ব্যবহার
অনেক বিক্রেতা চীন থেকে আমদামিকৃত নিম্নমানের এসিতে নামী ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করে। এসব এসির তার বা কেবল, সাকশন পাইপ, রেফ্রিজারেন্ট, কম্প্রেসর প্রভৃতি অংশের গুণগত মান অত্যন্ত খারাপ। অল্প কিছুদিনের ব্যবহারেই তা বিকল হয়ে যায়। অথবা, গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সেক্ষেত্রেম এগুলোতে নিয়মিত সার্ভিসিং করালেও ভালো ফল পাওয়া যায় না এবং এক সময় তা বিস্ফোরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সুতরাং, বিস্ফোরণ ঠেকাতে নিম্নমানের এসি কেনা থেকে বিরত থাকুন।
২. রুমের লোড অনুযায়ী এসির ব্যবহার না করা
প্রত্যেকটি রুমের আকার অনুযায়ী এসির নির্দিষ্ট মাপ থাকে। যেমন, ১ টন কিংবা দেড় টন ইত্যাদি। একটি অত্যাধিক বড় রুমে যদি ১ টনের এসি লাগানো হয়, তবে ঐ ঘরটি ঠান্ডা রাখতে অতিরিক্ত চাপ পড়বে। এর রেফ্রিজারেন্ট অংশ এত চাপ নিতে পারবে না। ফলে, এসির অভ্যন্তরীণ অংশগুলো বিকল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এ কারণেই রুম অনুযায়ী এসির ব্যবহার করা উচিত। অন্যথায় ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে৷ দামে মাত্র অল্প কিছু টাকা সাশ্রয় করতে গিয়ে তখন পুরো টাকাটাই জরিমানা। সুদ হিসেবে হয়ত প্রাণটাও দিতে হতে পারে।
৩. ধুলা বা ময়লার আস্তরণ
বিভিন্ন কারণে এয়ার কন্ডিশনার এর কনডেন্সার কয়েলে ধুলা, ময়লা ইত্যাদি জমতে পারে। এক্ষেত্রে এসির কার্যকারিতা সম্পন্ন করতে বেশি তাপ এবং চাপের প্রয়োজন হয়। কারণ, এই অবস্থায় এসি থেকে সুষ্ঠুভাবে তাপ নিষ্কাশন হতে পারে না।
তাই, যখন বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়, তখন এসির অভ্যন্তরীণ সমস্যা সৃষ্টি হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। এই ধুলো ময়লা নিয়মিত পরিষ্কার না করলে এসির অভ্যন্তরীণ অংশগুলোতে বাধার সৃষ্টি হয়।
৪. অপর্যাপ্ত লুব্রিকেন্ট
লুব্রিকেন্টকে এসির রক্ত বললেও হয়ত ভুল হবে না। আমাদের শরীরের বিভিন্নমুখী কার্যক্রমে যেমন রক্তের প্রয়োজন, তেমনি এসির কার্যকারিতা সঠিকভাবে চলার জন্য লুব্রিকেন্টের প্রয়োজনীয়তা অনবদ্য।
এসি নিয়মিতভাবে একজন দক্ষ ব্যক্তির দ্বারা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এতে তিনি লুব্রিকেন্টের পরিমাণ নির্ণয় করে এসির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারেন। যার ফলে এসিতে কোনো প্রকার অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি হয় না। অন্যথায়, এসির লুব্রিকেন্টের মাত্রা কমে গেলে যে কোনো ধরণের সমস্যা হতে পারে।
৫. সাকশন লাইনের গোলযোগ
এসির বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন কাজের জন্য নির্ধারিত। এসির বিভিন্ন অংশে অনেক সময় ধুলো ময়লা জমতে পারে অথবা অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এর পাইপগুলোতে প্রতিবন্ধকতার সূত্রপাত হয়। এমতাবস্থায় এসি ঘর ঠান্ডা রাখার কার্যকারিতা বা সক্ষমতা কমতে থাকে।
এই সমস্যা যদি শীঘ্রই সমাধান না করা হয়, তবে তা এসি বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে।
৬. শীতলক অংশের সক্ষমতা হ্রাস
অনেক সময় এয়ার কুলারের শীতলক অথবা রেফ্রিজারেন্ট অংশে গোলযোগ কিংবা ত্রুটি সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রেই ফাটলও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে এসি যেখানে রাখা আছে সেই স্থান শীতল রাখার স্বার্থে কম্প্রেসর অংশে অতিরিক্ত তাপ এবং চাপের প্রয়োজন হয়।
এই অতিরিক্ত তাপ এবং চাপের সরবরাহে অনেক সময়ই এসির কম্প্রেসরে ত্রুটি তৈরি হয় এবং এতে বিস্ফোরণ ঘটে।
৭. বৈদ্যুতিক সমস্যা
বৈদ্যুতিক গোলযোগজনিত কারণে এসিতে এসিডের সৃষ্টি হয়। এছাড়াও, এসির বিভিন্ন তার বা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুড়ে যেতে পারে৷ হাই ভোল্টেজ কিংবা অনেক সময় ভোল্টেজ কম বেশি হতে থাকলে এসির কার্যকারিতা তার সাথে তাল মেলাতে পারে না। এতে এর ভিতরের অংশ পুড়ে গিয়ে এসিডের সৃষ্টি করতে পারে। সেক্ষেত্রে, সঠিকভাবে সেই সমস্যাটি সমাধান না করলে এসির অভ্যন্তরীণ সমস্যা বেড়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে তা এসির বিস্ফোরণ ঘটায়।
বিশেষত, কম্প্রেসর অংশে গোলযোগ থাকলে এই এসিডের ক্ষতিকর প্রভাব আরও বেশি হতে পারে। তাই, এক্ষেত্রে খেয়াল রাখা অবশ্যক। এসিতে সবসময় সঠিক স্পেকের কেবল বা তার ব্যবহার করতে হবে এবং এসিতে সঠিক রেটিং এর সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করতে হবে। এসির হাই ভোল্টেজ এড়াতে সার্কিট ব্রেকার প্রয়োজন। যাতে অতিরিক্ত ভোল্টেজ যখন এসির ভেতর দিয়ে পাস হবে, তখন তৎক্ষনাৎ এসির সার্কিট বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
৮. অতিরিক্ত শীতলক ব্যবহার
আপনি যখন এসির সার্ভিসিং করাবেন, তখন এসির কোনো সমস্যা সমাধানের স্বার্থে সব সময়ই দক্ষ ব্যক্তির সহায়তা নেবেন। কারণ, সঠিক জ্ঞানের অভাবে অনেকেই সঠিক শীতলক বা রেফ্রিজারেন্ট অংশের ব্যবহার করেন না।
আবার, অনেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শীতলক তারের সংযোগ দিয়ে থাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোনো কিছুই কল্যাণকর নয়। যার ফলে, এসির সমস্যা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এতে এসি দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার সম্ভাবনাও প্রচুর।
৯. সঠিক মাপের সাকশন লাইন ব্যবহার না করা
সাকশন লাইনের সঠিক ব্যবহার এসির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। ছোট কিংবা বড় মাপের সাকশন টিউব ব্যবহার করলে সেখানে এসির কার্যকারিতা সঠিকভাবে চলতে পারে না এবং এক্ষেত্রে একজন দক্ষ এসি কারিগরের প্রয়োজন। যে সবকিছু সঠিকভাবে পরিমাপ করে সমস্যার সমাধান করতে পারে।
১০. সিস্টেমে দূষণ
এসিতে সর্বদা অতিরিক্ত তাপ এবং চাপের প্রয়োজন হয়। সঠিকভাবে কাজ সম্পাদনের জন্য এসির চারপাশের পরিবেশ সর্বদা দূষণমুক্ত থাকা প্রয়োজন। এই দূষণ বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন- বায়ু দূষণ, তাপমাত্রা কিংবা আর্দ্রতাজনিত সমস্যা, ধুলো, এসিড, গাছের পাতা, পাখি কিংবা পোকামাকড় ইত্যাদি।
এ ধরণের দূষণ থেকে এসির আশপাশ সবসময় পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করতে হবে। নয়ত দূষণের কারণে এসির গোলযোগপূর্ণ সিস্টেম সৃষ্টি হবে যার ফলে বিস্ফোরণ হয়ে থাকে।
১১. রক্ষণাবেক্ষণের অভাব
এসি ব্যবহারের কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। যেমন, এসি চালু করার সময় ঘরের সকল জানালা দরজা ইত্যাদি বন্ধ রাখতে হবে, যেনো বাইরের বাতাস ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। আবার, সঠিক তাপমাত্রারও নির্দেশনা আছে। এসি দীর্ঘক্ষণ চালানো অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে এর ভেতরের অংশগুলোতে ক্রমাগত চাপ পড়তে থাকে।
ভালো আর্থিং ব্যবস্থা না থাকলে বজ্রপাত কিংবা বৃষ্টির সময় এসি বন্ধ রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে এসি নষ্ট হওয়ার কোনো ধরণের ঝুঁকি থাকে না। আবার, অনেক সময় উইন্ডো এসির সামনে জানালা বা পর্দা জাতীয় কাপড় চলে আসে। এগুলো সরিয়ে না দেওয়া হলে এসির কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি হয় যা এসিকে গরম করে তুলতে পারে।
এসির যেসকল ত্রুটি রয়েছে তার কোনোটিই ব্যয়বহুল নয়। একজন দক্ষ এবং পেশাদার ব্যক্তি খুব সহজেই এসির সার্ভিসিং করতে পারেন। কোনো ত্রুটি আছে কিনা পরীক্ষা করে ত্রুটি থাকলে তার সমাধান দিতে পারেন। ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে তাপমাত্রা মারাত্মক হারে বাড়ছে। ফলে অসহ্য গরমের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এসির ব্যবহারও আমাদের জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কিন্তু নিত্যদিন বিভিন্ন কারণে এসির ব্যবহার নিজেদের জন্যই হুমকি হিসেবে গড়ে নিচ্ছি।
কখনও হয়ত অল্প কিছু টাকা সাশ্রয় করতে গিয়ে নিম্নমানের কিংবা অপর্যাপ্ত পরিমাণ এসি কিনে নিজেদের ঠেলে দিচ্ছি বিপদের মুখে। যা এসি বিস্ফোরণের কারণ হয়ে উঠে প্রায়ই। তাই, এসি যেমন আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। তেমনি আমাদেরও উচিৎ এসির চারপাশে সঠিক এবং সুষ্ঠু আবহাওয়া তৈরি করা। একইসাথে এসির ব্যবহারে নিজেদেরও সচেতন করে তোলা। তাহলেই এই বিপদের হাত থেকে মুক্তি মিলবে আমাদের।
Leave a Reply