আপনাকে কি কখনো ইসিজি করতে হয়েছে? কিংবা, আপনার কোনও আত্মীয়-স্বজনকে? ডাক্তার যখন ইসিজি করতে দেয়, অনেক মানুষই ভড়কে যায়। মনে করে কি না কি! কারণ, এমন একটা সময়ে ডাক্তার ইসিজি করতে দেন, যখন রোগী বড় ধরণের কোনও সমস্যার সন্মুখীন। তাই, ভড়কে যাওয়াই স্বাভাবিক!
কিন্তু ইসিজি ভড়কানোর মতো বড় ধরণের কোনও টেস্ট নয়। এটি সাধারণ এবং সচরাচর সাজেস্টেড একটি মেডিকেল টেস্ট। এর আরেক নাম ইকেজি (EKG)। আসুন, এই ইসিজি বা ইকেজি সম্পর্কে বিস্তারিত সবকিছু জানা যাক-
ইসিজি কি?
হৈচৈ বাংলার আগের পোস্টে আমার সিটি স্ক্যান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ পাওয়ার পর অনেকেই ইসিজি নিয়েও একই রকম একটি লেখা পোস্ট করার জন্যে অনুরোধ করেছেন। তাই, তাদের জন্যে এই লেখা।
Electrocardiogram এর সংক্ষিপ্ত রূপ ECG যার E এসেছে Elec থেকে C এসেছে Cardio থেকে আর G নেয়া হয়েছে Gram থেকে।
ইসিজি একটি মেডিকেল টেস্ট যা দিয়ে হার্টের রোগ নির্ণয় করা হয়। ডাক্তার যখনই কারো হার্টে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন, তখনই ইসিজি করতে বলেন।
ইসিজি মূলত হার্টের ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি রেকর্ড করে থাকে এবং সেটাকে কম্পিউটার বা ল্যাব স্ক্রিনে শো করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, ইসিজির রেজাল্টকে বিশেষ এক ধরণের কাগজে প্রিন্ট আউট নেয়া হয়। এটাকে মেডিকেলের ভাষায় ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফ বলা হয় যা দেখে ডাক্তার তার কাছে আগত রোগীর হার্টের সমস্যা চিহ্নিত করেন।
সাধারণত, হার্টের ইসিজি করার পর যদি দেখা যায় সেটির ক্যারেক্টারিস্টিক শেপ রয়েছে, তবে ধরে নেয়া হয় হার্টটি সুস্থ্য রয়েছে। অর্থাৎ, হার্টে কোনও সমস্যা নেই। আর যদি হার্ট বিটে কোনও অসামঞ্জস্যতা থাকে, হার্ট বিট যদি কম বা বেশি হয়, তবে হার্টের ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি থেকে সেটি বোঝা যায়। অর্থাৎ, হার্টের ক্যারেক্টারিস্টিক শেপটা আর থাকে না।
মূল কথা হচ্ছে, যে মেডিকেল টেস্টটি ইলেকট্রিক্যাল অ্যাক্টিভিটি গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের হার্টের রেট ও রিদম প্রকাশ করে, যা থেকে হার্টের সমস্যা ধরা পড়ে, তাকে ইসিজি বলে।
ইসিজি কেন করা হয়?
এমআরআই (MRI) কি ও কেন করা হয়, তা আপনি হয়তো ইতিমধ্যেই জেনেছেন। চলুন আজ জানা যাক ইসিজির কারণ ও উদ্দেশ্য।
সব মানুষের ক্ষেত্রেই ইসিজি করার কারণ এক হয় না। তবে, বড় ধরণের কোনও সার্জারির আগে কিংবা হার্টের কোনও সমস্যা আছে বলে সন্দেহ হলে, সবার ক্ষেত্রেই ইসিজি করতে হয়। এছাড়াও, আরো নানা কারণে প্রায়ই ইসিজি করার প্রয়োজন পড়ে।
আসুন, জানা যাক কোন কোন ক্ষেত্রে আপনার ইসিজি করার প্রয়োজন হতে পারে।
আপনার যদি হার্ট পালপিটিশন হয়
হার্ট পালপিটেশন বা ধড়ফড়ানি হ’ল হার্ট বিট বা হৃদস্পন্দন যা হঠাৎ করে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। আপনি অনুভব করতে পারেন যে আপনার হার্ট বিট অনিয়মিতভাবে প্রস্ফুটিত হয়, কয়েক সেকেন্ড বা কয়েক মিনিটের জন্য ধাক্কা খায় বা নাড়াচাড়া করে।
অনেক ক্ষেত্রে এই পালপিটেশন ক্ষয়ক্ষতিহীন, অর্থাৎ তেমন রিস্কি নয়। কেননা, স্ট্রেস, অত্যধিক ক্যাফিন জাতীয় খাবার গ্রহণ বা হরমোনের পরিবর্তনের মতো লাইফস্টাইল ট্রিগারের কারণে হতে পারে। তবে, সেটা এট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন, অ্যাট্রিয়াল ফ্লোটার বা টাকাইকার্ডিয়া জাতীয় হার্ট সমস্যার লক্ষণও হতে পারে।
হার্টের পালপিটিশনের কারণ চিহ্নিত করার জন্য আপনাকে হার্ট মনিটরিং পরীক্ষা করাতে হবে যার নাম হল্টার মনিটর টেস্ট যা মূলত ইসিজির একটা পার্ট।
আপনার যদি হঠাৎ করে মাথা ঘোরে বা শ্বাসকষ্ট হয়
নানা কারণেই আপনার মাথা ঘুরে উঠতে পারে। কিংবা, মাথা ব্যথার মতো হালকা শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। এমনকি, মারাত্মক শ্বাসকষ্টে ভুগতে পারেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ-সব শারীরিক সমস্যার সঙ্গে হার্টের কোনও সম্পর্ক থাকে না। কিন্তু, এগুলোর সাথে এমন কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলো হার্টের সমস্যার দিকেই ইঙ্গিত করে।
যাইহোক, এই সমস্ত লক্ষণগুলো যদি আপনার মধ্যে দেখা দেয়, হোক সেটা হঠাৎ করে কিংবা মাঝে মাঝে, আপনার অবশ্যই ইসিজি করা উচিৎ। কারণ, আমাদের হার্ট রিদমের ক্ষেত্রে যদি ডিজঅর্ডার দেখা দেয়, তবে অনেক সময় সেটি মৃত্যু পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
যদি কখনও বুকে ব্যথা অনুভব করেন
হঠাৎ পেশীতে টান পড়ার মতো ছোট বিষয় থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাকের মতো বড় সমস্যার কারণেও বুকের ব্যথা হতে পারে। বুক ব্যথার অন্তত ২০টি কারণ রয়েছে। তাই, বুকে ব্যথা হলে সেটাকে কখনও এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়।
আপনি যদি কখনও বুকের তীব্র ব্যথা অনুভব করেন, তবে সেটিকে বিকাশ হতে না দিয়ে আপনার অবিলম্বে ডাক্তারে চিকিৎসা সহায়তা নেওয়া উচিত। আর যদিও বুকে ব্যথা সবসময় আপনার হার্টের সমস্যার কারণে হয় না, এটি কখনও কখনও এনজাইনা বা হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ হতে পারে, উভয় গুরুতর ঘটনা হৃদপিণ্ডের পেশীতে সীমাবদ্ধ রক্ত প্রবাহ সম্পর্কিত।
কাজেই, বুক ব্যথার কারণ নির্ণয় করার জন্যে আপনার অবশ্যই ইসিজি করা উচিৎ।
আপনার যদি ইরেগুলার হার্টবিট হয়
আপনার নিয়মিত ব্লাড প্রেশার যদি ঘন ঘন অনিয়মিত হার্টবিট শো করে, তবে ডাক্তার আপনাকে ইসিজি চেক করতে দিতে পারেন। কারণ, অনিয়মিত হার্টবিট অনেক সময়ই বিপজ্জনক হতে পারে।
আমরা প্রায় প্রত্যেকেই কখনো না কখনো হৃদপিণ্ডের ঝাঁকুনি, পালপিটিশন বা ধড়পড়ানির অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকি এবং অনুভব করি আমাদের হার্ট মাঝে মাঝে বিট করার ক্ষেত্রে ইরেগুলার হয়ে যায়। এটা অ্যারিথমিয়াস নামক হার্ট ডিজিজের লক্ষণ যা নির্ণয় করার জন্যে ইসিজির প্রয়োজন।
যদিও এই সমস্যাটি কখনো কখনো খুবই সাধারণ আবার কখনো এটি অত্যন্ত বিপদজনক হতে পারে, তাই ডাক্তার আপনাকে ইসিজি করতে বললে বিরক্ত না হয়ে করে নিন যাতে বড় ধরণের হার্ট সমস্যা দেখা দেওয়ার আগেই সেটি শনাক্ত করা যায় এবং প্রপার ট্রিটমেন্ট নেয়া যায়।
আপনার যদি হাই ব্লাড প্রেশার থাকে
সনাক্ত করা যায় না এমন, চিকিৎসাবিহীন এবং নিয়ন্ত্রণহীন উচ্চ রক্তচাপ হ’ল হার্ট সম্পর্কিত বেশিরভাগ সমস্যার প্রধান কারণ। এটি আপনাকে স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের দিকে পরিচালিত করতে পারে এবং এট্রিয়াল ফাইব্রিলেশনের মতো হার্ট অ্যারিথমিয়াসের ঝুঁকি বাড়ায়।
কাজেই, আপনি যদি হার্টে কোনও সমস্যা অনুভব করেন আর যদি এটি প্রকাশ পায় যে আপনার হাই ব্লাড প্রেশার রয়েছে, তবে ইসিজি করেই আপনার হার্টের সমস্যা চিহ্নিত করতে হতে পারে।
আপনার পরিবারে যদি কারো হৃদরোগ থাকে
অনেক পরিবারেই হার্ট ডিজিজ থাকে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তে চলে যায়, অর্থাৎ পরবর্তী জেনারেশন এই হার্টের রোগ ক্যারি করতে থাকে। যদি আপনার পরিবারের সদস্যদের কেউ উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের শিকার হয়ে থাকেন, তবে আপনার মধ্যেও জেনিটিক্যাল্লি হার্টের সমস্যা ডেভেলপ করতে পারে। আর সেটি ফাইন্ড আউট করার জন্যেই ইসিজি করা দরকার হয়।
ধরা যাক, আপনি স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনও করছেন এবং হার্ট রিলেটেড কোনও সমস্যার সম্ভাবণাই নাই। কিন্তু আপনার ফ্যামিলিতে, বিশেষ করে আপনার দাদা-দাদী কিংবা নানা-নানী অথবা আপনার বাবা-মা’র মধ্যে কারো যদি হৃৎরোগ থাকে, তবে আপনার ক্ষেত্রেও ঝুঁকির সমস্যা রয়েছে। কাজেই, আপনি যদি এমন কোনও শারীরিক সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান, যার সঙ্গে হার্টের সম্পর্ক রয়েছে, আর ডাক্তার যদি জানতে পারেন আপনার ফ্যামিলিতে হার্ট ডিজিজ রয়েছে, তবে অবশ্যই আপনাকে ইসিজি করাতে বলবেন।
উপরোক্ত কারণগুলো ছাড়াও আরো এমন অনেক সমস্যা রয়েছে যেগুলোর জন্যে একজন ডাক্তার তার রোগীকে ইসিজি করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অনেক সময় আমরা ডাক্তারের উপর বিরক্ত বোধ করে এই ভেবে যে, ডাক্তার শুধু শুধু টাকা খাওয়ার জন্যে নানা রকম টেস্ট দেয়।
কথাটা দু’একজন ডাক্তারের ক্ষেত্রে সত্য হতেও পারে। কিন্তু মনে রাখবেন, ডাক্তার যদি ল্যাব টেস্ট না করেন, তবে আপনাকে অনুমানের উপর ঔষধ দেবেন। আর অনুমান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি হয় না। কাজেই, প্রপার ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায় না। সুতরাং, কোনদিন ডাক্তার যদি আপনাকে ইসিজি করতে বলেন, তবে ডাক্তারকে ভুল না বুঝে দ্রুত ইসিজি করে নেবেন।
এক নজরে ইসিজির কারণ-
- হঠাৎ বা প্রায়ই বুক ব্যথা
- নি:শ্বাস নিতে সমস্যা
- ক্নান্ত বা দূর্বল অনুভব করা
- হার্ট পালপিটিশন বা ধড়পড়ানি
- অনিয়মিত হার্ট বিট, ইত্যাদি।
ইসিজির মাধ্যমে ডাক্তার যা জানার চেষ্টা করেন
- রোগীর হার্ট বিট
- রক্ত প্রবাহের স্বল্পতা
- সুনিশ্চিত বা সম্ভাব্য হার্ট অ্যাটাক
- হার্টের পেশীর অ্যাবনরমালিটি
- হাই পটাশিয়াম কিংবা হাই বা লো ক্যালসিয়াম জনিত ইলেকট্রোলাইট অ্যাবনরমালিটি
ইসিজি কত প্রকার ও কি কি
উপরে আলোচিত বিভিন্ন ধরণের শারীরিক সমস্যা নির্ণয়ের জন্যে যে ইসিজি বা ইকেজি করা হয়, তা সব সময় বা সব সমস্যার জন্যে এক রকম নয়। বরং, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। নিচে সেগুলো উল্লেখ করা হলো-
- স্ট্রেস টেস্ট
- হল্টার মনিটোরিং
- ইভেন্ট রেকর্ডার
ইসিজির জন্যে প্রস্তুতি
ইসিজির জন্যে তেমন কোনও প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। শুধুমাত্র ইসিজি করার আগে ঠান্ডা পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হয়। যাদের নিয়মতি ব্যায়াম করার অভ্যেশ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ইসিজির দিন ব্যায়াম না করাই উত্তম। কেননা, শারীরিক ব্যায়াম হার্টের বিট রেট বাড়িয়ে দেয় যা সঠিক রেজাল্টের ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।
ইসিজি’র রিস্ক ফ্যাক্টর
ইসিজির তেমন কোনও রিস্ক নেই। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ইলেকট্রোডস্ দেয়ার কারণে ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। কিন্তু, এটি তেমন বড় কোনও সমস্যা নয়। কোনও চিকিৎসা ছাড়াই চামড়ার এই ফুসকুড়ি ধীরে ধীরে ভাল হয়ে যায়।
ইসিজির খরচ কত?
ইসিজির খরচ একেক হাসপাতালে একেক রকম। তবে, খরচ খুব একটা বেশি নয়। ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা।
Leave a Reply