সুষম খাদ্যের যে ৬টি উপাদান রয়েছে তার মধ্যে খনিজ পদার্থ অন্যতম। খনিজ পদার্থের মধ্যে আয়রন একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের শরীরে আয়রনের অভাব রয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রেই এই সমস্যা বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশে প্রায় ৫১ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা বিশ্বে কিশোরী থেকে প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় ৬১ কোটি নারী রক্তস্বল্পতার স্বীকার। এ রক্তস্বল্পতার অন্যতম প্রধান একটি কারণ শরীরে আয়রনের অভাব। উন্নত দেশ কানাডাতেও প্রায় ৮ শতাংশ নারী দেহে আয়রন ঘাটতি পাওয়া গেছে।
আয়রনের অভাব জনিত লক্ষণ
দেহে আয়রনের অভাব হলে অভাবজনিত কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। আপনার দেহে আয়রন ঘাটতি আছে কিনা তা জানতে এই লক্ষণগুলোর সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন-
অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা
রক্তের অন্যতম একটি উপাদান হিমোগ্লোবিন। আপনি হয়তো জানেন হিমোগ্লোবিন কি ও এর কাজ কি। আমাদের দেহে অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান পরিবহনের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে থাকে হিমোগ্লোবিন।
শরীরের শতকরা ৭০ ভাগ আয়রন এই হিমোগ্লোবিন তৈরিতে ব্যয় হয়। আয়রনের ঘাটতি হলে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শরীরে হিমোগ্লোবিন ঘাটতি এবং পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
রক্তে অক্সিজেন কমে গেলে হৃদযন্ত্র শরীরে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করতে চেষ্টা করে। এ সময় হৃদযন্ত্র বেশি বেশি পাম্প করতে থাকে। পাম্প করার গতি কখনো কম, কখনো বেশি থাকে। ফলে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন দেখা যায়। বুকে হাত দিয়েও এ স্পন্দন অনুভব করা যায়। এছাড়াও আরো কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, যেমন-
- খুব দ্রুত হৃদস্পন্দন হওয়া।
- বুক ধড়ফর করা।
- হৃদপিন্ডের আকার বৃদ্ধি।
- হার্ট ফেইলিউর।
আয়রনের অভাব জণিত অক্সিজেন স্বল্পতায় এ ধরণের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
অস্বাভাবিক ক্লান্তি অনুভব করা
অক্সিজেন দেহের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। আয়রনের অভাবে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শরীরে অক্সিজেনের প্রবাহ কমে যায়। অক্সিজেনের অভাবে দেহকোষ ও অন্যান্য টিস্যুগুলোর কাজ করার শক্তি কমে যায়। ফলে অল্প পরিশ্রমেই শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
রোজকার কাজকর্মে আমরা এমনিতেই ক্লান্তি অনুভব করি। যার কারণে আয়রন ঘাটতি জনিত ক্লান্তি এবং স্বাভাবিক কাজকর্মে ক্লান্তির মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন।
ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
এটি আয়রন ঘাটতির অন্যতম লক্ষণ। আয়রনের অভাব হলে ত্বক বিবর্ণ হয়ে যায়। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় এ লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-
- মুখমন্ডল,
- দাঁতের মাড়ি,
- চোখের নিচের পাতার ভেতরের অংশ,
- নখ ইত্যাদি।
আয়রনের অভাবে রক্তের পরিমাণ কমে গেলে রক্তের লালচে ভাব ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ফলে দেহের ত্বক বিবর্ণ দেখায়।
ঘন ঘন মাথাব্যথা
মস্তিষ্ক দেহের গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। আয়রন ঘাটতি জনিত রক্তাল্পতায় মস্তিষ্কে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যায়। অক্সিজেন পাওয়ার জন্যে প্রতিবর্ত ক্রিয়া হিসেবে মস্তিষ্কের রক্তনালী প্রসারিত হতে থাকে।
এ সময় ঘন ঘন মাথা ব্যথা, মাথা ঘুরা, মাথা ঝিমঝিম করা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। যদিও দ্রুত মাথাব্যথা দূর করার নানা উপায় আছে, তবু আয়রনের ঘাটতি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া
আয়রনের অভাবে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে রক্তে অক্সিজেন কম পৌঁছায়। এ সময় শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত হতে থাকে। অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শ্বাস বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না।
এছাড়াও হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে থাকে। রোগী অস্বস্তি ও ক্লান্তি অনুভব করে।
ফ্যাকাশে জিহ্বা
মায়োগ্লোবিন এর অভাবে জিহ্বার রঙ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। মায়োগ্লোবিন এক ধরনের প্রোটিন, যার গাঠনিক উপাদানের মধ্যে রয়েছে আয়রন। আয়রন কমে গেলে মায়োগ্লোবিনও কমে যায়।
এছাড়াও আয়রনের অভাবে জিহ্বায় আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়, যেমন-
- জিহ্বা ফুলে যাওয়া।
- জিহ্বায় ক্ষত হয়ে যাওয়া।
- কালশিটে দাগ হওয়া।
- সাদাটে হয়ে যাওয়া।
- জিহবা অদ্ভুত রকমের মসৃণ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
মুখে ক্ষত
মুখ ও মুখের চারদিকে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে দেহে আয়রনের অভাব বুঝা যায়। যেমন-
- মুখের ভেতর শুকিয়ে যাওয়া।
- মুখের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত।
- জিহ্বা ও গালের ভেতরে অংশে জ্বালাপোড়া করা।
- মুখের দুই পাশে বা কোণা গুলোতে ফেটে লাল হয়ে যাওয়া।
হাঁটা চলায় পায়ের ভারসাম্যহীনতা
John Hopkins Medicine এর তথ্য অনুযায়ী পায়ের ভারসাম্যহীন রোগীদের প্রায় ১৫% আয়রনের অভাবে ভোগেন।
আমাদের শরীরে ডোপামিন নামক একটি হরমোন ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে। আয়রনের অভাবে ডোপামিন এর ক্ষরণ কমে যায়। ফলে পায়ের ভারসাম্য ঠিক থাকে না।
মাত্রাতিরিক্ত চুল পড়া
প্রতিদিন ৬০ থেকে ১০০টি চুল পড়া স্বাভাবিক। এর বেশি চুল পড়লে তা আয়রন ঘাটতির অন্যতম লক্ষণ। এছাড়াও, আয়রনের ঘাটতি হলে চুলে আরো কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন-
- চুলের গোড়া নরম হয়ে যাওয়া।
- চুল রুক্ষ হয়ে যাওয়া।
- নিয়মিত যত্নের পরও চুল ফেটে যাওয়া।
- চুলের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
- চুল খড় বর্ণের হয়ে যাওয়া, ইত্যাদি।
পিরিয়ড ও গর্ভকালীন দুর্বলতা
পিরিয়ডের সময় অতিমাত্রায় ব্লিডিং হলে শরীর থেকে ফোলিক এসিড ও আয়রন বেরিয়ে যায়। অতিরিক্ত ব্লিডিং হওয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় মেনোরেজিয়া বলা হয়।
অন্যদিকে গর্ভকালীন সময়ে গর্ভের শিশু মা থেকে আয়রন নিয়ে থাকে। ফলে, মায়ের শরীরে আয়রণ ঘাটতি দেখা দেয়।
অতিরিক্ত পিরিয়ড ও গর্ভকালীন সময়ে আয়রনের অভাব হলে শরীরে এর ঘাটতি জনিত দুর্বলতাসহ অন্যান্য উপসর্গ দেখা দেয়।
আয়রনের অভাবে থাইরয়েড সমস্যা
শরীরে আয়রনের অভাব থাইরয়েডের সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়। থাইরয়েড থেকে নিঃসৃত হরমোন দেহের গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ নেয়। এটি ঠিকভাবে কাজ না করলে শরীরে কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়। যেমন-
- পরিশ্রম করার ক্ষমতা দিন দিন কমে যায়।
- শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়।
- ওজন বেড়ে যায়।
- কোন কারণ ছাড়াই শরীরে ব্যাথা অনুভূত হয় ইত্যাদি।
নখ ভেঙ্গে যাওয়া
এ লক্ষণটি খুব একটা দেখা যায় না। আয়রন ঘাটতিতে ভোগা ৫% মানুষের নখ ফাটা ও নখ ভাঙ্গা সমস্যা দেখা যায়। অনেক সময় নখের মাঝামাঝি অংশ ঢালু এবং দুই পাশের অংশ উঁচু হয়ে যায়। এটি দেখতে অনেকটা চামচের মত দেখায়।
খাদ্য পরিপাক জনিত সমস্যা
প্রতিদিনের খাবারে সঠিক পরিমান আয়রন না থাকলে দেহে আয়রনের অভাব দেখা দেয়। আয়রনের অভাবে খাদ্য প্রক্রিয়াকরনে সমস্যা হয়ে থাকে। ফলে পেট ব্যাথা, বদহজম, পুষ্টির অভাব ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়। সুতরাং, যে ১০টি খাবারে সবচেয়ে বেশি আয়রন রয়েছে, সেগুলো রাখুন প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায়।
হতাশায় ভোগা
কখনো কখনো ব্যক্তি নিজের হতাশার কারণ খুঁজে পায় না। আয়রন অভাবের অন্যতম একটি লক্ষণ হতাশায় ভোগা। এ সময় ব্যক্তি অজানা কারণে উদাসীনতায় ভোগে, বিরক্ত বোধ করে, শারিরীক দুর্বলতা অনুভব করে।
অখাদ্য বস্তু খাওয়ার ইচ্ছা
আয়রনের অভাব জনিত কারণে ব্যক্তি অখাদ্য বস্তু খাওয়ার আগ্রহ দেখায়। বিশেষ করে, শিশু এবং গর্ভবতী অবস্থায় এ অদ্ভুত লক্ষণটি দেখা যায়।
এ সময় অসুস্থ ব্যক্তি মাটি, চকপাউডার, কাদা, ময়লা, কাগজ ইত্যাদি অখাদ্য বস্তু খাওয়ার প্রতি আসক্তি অনুভব করে। এ অদ্ভুত অবস্থাটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় Pica বা পাইকা।
আয়রনের অভাব জনিত আরো কিছু লক্ষণ
আয়রনের অভাব জনিত অনেকগুলো লক্ষণ জানলাম। উপরের লক্ষনগুলো ছাড়াও আরো কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে। যেমন-
- অস্থিরতা বোধ করা।
- ধৈর্য ক্ষমতা কমে যাওয়া।
- মেজাজ খিটখিটে থাকা।
- মাংস পেশি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে দুর্বলতা অনুভব করা।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া।
- স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়া।
- ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশ কম হওয়া।
- হাত ও পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া।
শেষ কথা
শরীরে আয়রন ঘাটতি দেখা দিলে কোনভাবেই অবহেলা করা যাবে না। যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। দীর্ঘদিন যাবত আয়রন ঘাটতি থাকলে বড় ধরণের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খাদ্যতালিকায় সুষম ও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার থাকলে সহজেই আয়রন ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
Leave a Reply