গরমে চরম আরাম পেতে অত্যন্ত মোখরোচক হলেও আইসক্রিমের ক্ষতিকর দিক রয়েছে অনেকগুলো। যারা মিষ্টি জাতীয় এই ফ্রোজেন ফুডটি খেতে খুব পছন্দ করেন, তারা কখনো আইসক্রিমের অপকারিতা নিয়ে ভাবেন না। কিন্তু সচেতন মানুষ মাত্রই সব ধরণের খাবারের উপকারিতা নিয়ে যেমন ভাবেন, তেমনই ভাবেন অপকারিতা নিয়েও।
আইসক্রিমের নাম শুনলে মুখে জল আসে না এমন মানুষ পাওয়া যায় না বললেই চলে। এর মিষ্টি মধুর স্বাদ আর বাহারি ডিজাইন সহজেই ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আইসক্রিমের স্রষ্টা চীন। স্রষ্ট্রা যেই হোক, পুষ্টিগুণ বৃদ্ধি এবং শারীরিক ক্লান্তি লাঘবে আইসক্রিমের জুড়ি মেলা ভার।
প্রায় সব ঋতুতেই রয়েছে আইসক্রিমের গ্রহণযোগ্যতা। তবে গ্রীষ্মকালে আইসক্রিমের চাহিদা তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই বলা যায়। তীব্র গরমে, ক্লান্তিকর দিনের শেষে এক চামচ আইসক্রিম আপনাকে দিতে পারে প্রগাঢ় সজীবতা। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে এই টুকুন আইসক্রিমই যথেষ্ট।
একটু পেছনের দিকে তাকালেই দেখতে পাই আজকের এ আইসক্রিমের মূল ধারণাটা বহু প্রাচীন। সম্রাট আলেকজান্ডার দি গ্রেট মধুকে হিমায়িত করে আইসক্রিম হিসেবে খেতেন। এরপর আস্তে আস্তে আইসক্রিমের ধারা পাল্টাতে শুরু করে। মধুর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় দুধ এবং চিনি।
সময়ের সাথে সাথে আইসক্রিম প্রস্তুতিতে যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন উপাদান। সে-সব উপাদান আইসক্রিমকে যেমন আপনার কাছে সুস্বাদু এবং আকর্ষণীয় করছে, তেমনি আপনাকে ঠেলে দিচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে।
হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। চলুন জেনে নিই আইসক্রিমের ১০টি ক্ষতিকর দিক-
আইসক্রিমের ক্ষতিকর দিক
যদিও আইসক্রিমের ৮টি উপকারিতা রয়েছে, তবু এর ক্ষতিকর দিকগুলোকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। বরং, গুরুত্ব সহকারেই এগুলো বিবেচনায় রাখতে হবে। সুতরাং, আইসক্রিমের এই সব ক্ষতিকর দিকগুলো জেনে রাখুন।
১. আইসক্রিম শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে
আইসক্রিমে ব্যবহৃত ডেইরী প্রোডাক্ট শরীরে ফ্যাট এবং ক্যালরীর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত ক্যালরি আপনার শরীরে মেদ কোষের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।
এছাড়া, আইসক্রিমে থাকা চিনিতে থাকে উচ্চমাত্রার কার্বোহাইড্রেট যা শরীরের ওজন বৃদ্ধি করে।
২. ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য আইসক্রিম ক্ষতিকর
যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের জন্য আইসক্রিম কাল স্বরুপ। আইসক্রিমে ব্যবহৃত চিনি ডায়াবেটিসের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। আইসক্রিমে তৈরীতে ব্যবহৃত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ সরাসরি ডায়াবেটিসের সাথে সম্পৃক্ত।
বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, আইসক্রিম তৈরিতে ব্যবহৃত এক্সট্রা সুইটনার সুস্থ শরীরেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
৩. আইসক্রিম হার্ট-অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়
ফ্রোজেন বা হিমায়িত খাবার হৃদরোগে আক্রান্তদের জন্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর সেই খাবার যদি হয় আইসক্রিম, যা মাইনাস ৬ ডিগ্রির (-৬°) এর চেয়েও নিচে, তাহলে ভাবুন তো কি অপেক্ষা করছে একজন হৃদরোগীর জন্য।
আজকাল বাজারে সোডিয়াম সাইট্রেটের পরিবর্তে বিক্রি হচ্ছে সোডিয়াম সাইক্লামেট যা দেখতে পুরোপুরি চিনির মতো। এই সোডিয়াম সাইক্লামেট হার্টের গতির উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আইসক্রিমে থাকা উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল হার্ট-অ্যাটাকের ঝুঁকি সামলাতে বাঁধা প্রদান করবে। আজকাল হার্ট অ্যাটাকের সম্মুখীন হতে কোনো বয়স লাগে না। যে কোন বয়সেই হার্ট-অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই, ঝুঁকি এড়াতে মাত্রাতিরিক্ত আইসক্রিম আসক্তি বাদ দিন।
৪. আইসক্রিম গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বৃদ্ধি করে
শুনতে হাস্যকর মনে হলেও এটাই সত্যি যে আইসক্রিম গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়ায়। দৈনন্দিন জীবনে আমরা এমন কিছু খাবার খেয়ে থাকি যার কোনো পুষ্টিগুণ থাকে না। শুধুমাত্র মুখের রুচির জন্য খেয়ে থাকি। এই খাবারগুলো পাকস্থলীতে গ্যাস জমায়, যা পরবর্তীতে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা সৃষ্টি করে। আইসক্রিম এই ধরনের খাবার তালিকার মধ্যে অন্যতম।
আইসক্রিমে ব্যবহৃত বিভিন্ন রং এবং ফ্ল্যাভার এসিডিটি বাড়ায়। মাত্রাতিরিক্ত আইসক্রিম খাওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম আইসক্রিম যারা খায়, তাদের জন্য এ ধরনের ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
৫. আইসক্রিম হজমের সমস্যা তৈরি করে
আইসক্রিম তৈরিতে ব্যবহৃত চিনি এবং নির্যাস অনেকের হজমের সমস্যা বাড়ায়। হজম প্রক্রিয়াকে স্মুথলি ব্লক করতে আইসক্রিমে ব্যবহৃত চিনিই যথেষ্ট যে চিনি সম্পর্কে এর আগেও বলেছি।
এছাড়া, বর্তমানে আইসক্রিমে খাদ্য রঙের পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে কাপড়ের রঙ। এমন কি, নারকেলের গুঁড়ার সাথে প্লাস্টিকের গুঁড়া এবং দুধের পরিবর্তে চক পাউডার ব্যবহার করছে কিছু কিছু আইসক্রিম কোম্পানী। আর এ-সব রাসায়নিক উপাদান আপনার ডাইজেস্টিং প্রসেসকে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।
৬. আইসক্রিমের ফলে গলা ব্যাথার সৃষ্টি হয়
অতিমাত্রায় আইসক্রিম খাওয়ার দরুণ ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বিনষ্ট হয়, গলা ব্যাথার সৃষ্টি হয়। এতে গলার স্বর বসে যায়। খাবার গিলতে অসুবিধা হতে পারে।
৭. আইসক্রিম ফুসফুসের রোগ ত্বরান্বিত করে
আইসক্রিম ক্রোনিক এবস্ট্রাকট পালমোনারি ডিজেস (COPD) বা দীর্ঘকালীন ফুসফুসের রোগের জন্য দায়ী। আইসক্রিম খাওয়ার ফলে লাংস-এ পানি জমে। ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হয়।
এছাড়া, আইস্ক্রিমে থাকা বিভিন্ন রাসায়নিক ফুসফুসকে সহজেই আক্রমণ করে এর কার্যকারিতা ব্যাহত করে। তাই, শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য আইসক্রিম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
৮. আইসক্রিম ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়
অতিমাত্রায় আইসক্রিম ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্যি। আইসক্রিম বিক্রির উদ্দেশ্যে কোম্পানিগুলো এর নিরাপত্তা, সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতন থাকে না। তারা ক্রেতা আর্কষণ করার জন্য বিভিন্ন ধরণের দৃষ্টি আকর্ষক রঙ, নির্যাস ব্যবহার করে আর ব্যবহার করে বিভিন্ন মুখরোচক উপাদান যা ক্ষতিকর রাসায়নিকের তৈরি।
এই রাসায়নিকগুলো আপনার সুস্থ শরীরে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। আইসক্রিম খাওয়ার মাত্রা কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে এই ধরণের বিপদ এড়ানো সম্ভব।
৯. আইসক্রিম কিডনি সমস্যা বাড়ায়
এটাও হয়তো শুনে আপনার কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে যে আইসক্রিম কিডনিতে সমস্যা তৈরি করে। মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে কিডনি অন্যতম। মাত্রাতিরিক্ত আইসক্রিম খাওয়ার ফলে কিডনির কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
আইসক্রিমে বিশেষ করে ব্যবহার করা হয় দুধ এবং চিনি। দুধ সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন ডেইরী ফার্ম থেকে। কিছু কিছু ডেইরী ফার্ম অতিরিক্ত লাভের জন্য দুধ উৎপাদন করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে, মেডিসিনের মাধ্যমে।
অনেকসময় গরু দুধ দেয়ার উপযুক্ত না হলে ইনজেকশনের সাহায্যে পরিপক্ক করা হয়। অর্থাৎ, কৃত্রিম পদ্ধতিতে গরুকে দুধ দেয়ার উপযোগী করে তোলা হয়। জৈবিক উপায় ছাড়া কৃত্রিম পদ্ধতিতে তৈরি যে কোন খাবার আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর যা আপনার কিডনিকে অকার্যকর করে দিতে পারে। অবশ্য বাড়িতে তৈরী আইসক্রিম এ ধরনের ঝুঁকি হতে নিরাপদ।
১০. আইসক্রিম চোখের সমস্যা বাড়ায়, শরীরে অবসাদ এনে দেয়
আইসক্রিমে ব্যবহৃত উপাদানগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই অগ্নিদাহ্য পদার্থ। আইসক্রিম খাওয়ার ফলে চোখে জ্বালা-পোড়া করে। এই রাসায়নিকগুলো অনেক সময় ত্বকেও মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
এছাড়া, বর্তমানে আইসক্রিমের বিভিন্ন কোম্পানি নিজের ব্র্যান্ডের আইসক্রিম বেস্ট সেল হওয়ার জন্য আইসক্রিমে কোকেনসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য মেশাচ্ছে। যার ফলে ঐ ব্র্যান্ডের আইসক্রিমের প্রতিই ক্রেতা বেশি মাত্রায় ঝুঁকছে। ফলে অন্যদিকে এ আইসক্রিম খাওয়ার ফলে ক্রেতার মধ্যে অবসাদগ্রস্ততা, আলস্য ভর করছে।
আইসক্রিম আমাদের অনেকেরই পছন্দের খাবার। এর উপকারিতা-অপকারিতা দুই-ই আছে। অপকারিতার কথা ভেবে পছন্দের খাবার বাদ দিবেন, তা কি করে হয়? তাই, আইসক্রিমের ক্ষতিকর দিক এড়াতে পারেন বাড়িতে তৈরির মাধ্যমে। কিংবা খাওয়ার মাত্রা কমিয়ে আসুন আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা পাই। পছন্দের খাবার পছন্দের তালিকা হতে বাদ না পড়ুক।
নাসরিন আক্তার সিমা says
আইসক্রিম আমার ৫টি পছন্দের মধ্যে একটি। কিন্তু আপনার লেখাটি পড়ে আমার তো আইসক্রিমের প্রতি ভয় ধরে গেল। ১০টি পয়েন্টই অনেক যুক্তিযুক্ত। অবশ্য আমি নিজেও কয়েকটি পয়েন্ট ফেস করেছি। আইসক্রিম খেলে বদ হজম হয়, সাথে পেট খারাপও হয়। আগে তেমনটা গুরুত্ব দেইনি। আজ আপনার লেখাটি পড়ে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠলো। আইসক্রিমের নানা রকম ক্ষতিকর দিক নিয়ে এমন একটি মূল্যবান লেখা শেয়ার করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।