আমাদের অসুখী হওয়ার কারণ এবং ভেঙ্গে পড়ার পিছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা ভাগ্য বা অন্য কিছুকে দোষারোপ করে নিজেকে সান্তনা দিয়ে থাকি। কিন্তু বাস্তবতাটি হলো, আমরা আমাদেরই কিছু স্বভাবের কারণে সুখ থেকে বঞ্চিত হই। যে সব স্বভাব আমাদের সুখ কেড়ে নেয়, অহেতুক আমাদের অসুখী করে তোলে, সেগুলো নিয়েই আজকের লিভিং লাইফের নতুন পোস্ট।
প্রায় প্রতিটি মানুষের মাঝেই এমন কিছু স্বভাব থাকে, যা তার অজান্তেই তাকে অসুখী করে তোলে। এর মাঝে কিছু স্বভাব শুধু নিজেকেই নয়, পাশাপাশি অন্যদেরকেও অসুখী করে তোলায় তুমুল ভূমিকা রাখে। কাজেই, আমাদের সকলেরই জানা উচিৎ কোন স্বভাবগুলো থাকলে জীবনে সুখী হওয়া যায় না।
যে-সব স্বভাব থাকলে আপনি কখনোই সুখী হতে পারবেন না
মানুষের জীবনের সবচেয়ে কাঙ্খিত জিনিসই নিঃসন্দেহে সুখ ছাড়া আর কিছুই নয়। জীবন চলার পথে মানুষ যাই করুক না কেন, তার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হলো সুখী হওয়া। কে কখন কোন কাজের মাধ্যমে সুখ লাভ করবেন তা বলা কঠিন হলেও, সুখী হওয়ার জন্য প্রাথমিক কাজগুলি কিন্তু খুবই সহজ। কিন্তু এই সহজ ব্যাপারটিও অনেকের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ে।
যে মানুষ নিজে ভালো নেই, সে কখনও তার আশেপাশের মানুষগুলোর জন্যেও ভালো কিছু করতে পারবে না। শুধু তাই নয় গবেষণায় দেখা গেছে যে, অসুখী মানুষ নিজের সাথে সাথে পরিবার এবং সমাজে অশান্তি এবং অস্বাস্থকর পরিবেশ সৃষ্টিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই তারা জীবনের প্রতি অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে। পাশাপাশি অন্যদের জন্যেও এমন একজন মানুষের সাথে মেশা বা তার সাথে কাজ করা খুবই দুষ্কর হয়ে পড়ে, যে নিজের জীবনের প্রতি সন্তুষ্ট নয়।
জীবনে অসুখী হওয়ার কারণ
কোন মানুষের সুখী বা অসুখী থাকার নির্দিষ্ট কোন কারণ না থাকলেও ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ১২০০০ মানুষের সাক্ষাতকারে যে-সব তথ্য উঠে এসেছে তা রীতিমত চমকে দেওয়ার মত। গবেষকরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে, মানুষের মধ্যেই এমন কিছু স্বভাব রয়েছে যেগুলো তাকে অধিকাংশ সময়ে অসুখী করে এবং অবসাদে ডুবিয়ে রাখে। চলুন জেনে নিই সেই স্বভাবগুলি সম্পর্কে।
ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা:
কিছু কিছু মানুষের স্বভাব হলো সব সময় ভবিষ্যত নিয়ে নিশ্চিত থাকা। অস্বীকার করবো না যে জীবনে ইতিবাচক চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনি নিশ্চিত হয়ে বসে থাকবেন যে সব সময় ভাগ্য আপনার পক্ষেই থাকবে। ধরে নিন, আপনি একটি চাকরির ইন্টারভিউতে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে অবশ্যই আপনাকে ইতিবাচকটাই ভাবতে হবে। যদি না হয় তাহলে আপনি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলবেন।
কিন্তু তার পরিবর্তে আপনি যদি নিশ্চিত হয়ে ইন্টারভিউতে যান যে, আপনি আজ অবশ্যই চাকরিটা পাচ্ছেন। কাজেই, কোন কারণে যদি সেটা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে আপনার আর কোন ইন্টারভিউ দিতে ইচ্ছা করবে না। এমনকি, নতুন ইন্টারভিউ দিতে গেলেও মনে সব সময় এই ভয় কাজ করবে যে আপনার চাকরি হয়তো হবে না।
একাকিত্ব পছন্দ করা:
মানুষের সামাজিক জীব হয়ে ওঠার প্রধান কারণটি হলো একে অপরের সাথে ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করা। কিন্তু এর বিপরীত স্বভাবেরও কিছু মানুষ আমাদের চোখে পড়ে। এ ধরনের মানুষেরা সাধারণত যে কোন সমস্যা একা সমাধান করার চেষ্টা করেন। নিজের সফলতা বা ব্যর্থতা কারো সাথে আলোচনা করেন না এবং সর্বশেষ চিন্তাগ্রস্থ হলে সবার কাছ থেকে দুরে থাকার চেষ্টা করেন।
সমস্যাটি হলো আপনি যখন যে বিষয়ে চিন্তা করছেন বা ব্যর্থ হচ্ছেন তা নিয়ে যদি আলোচনা না করেন তবে খুব তাড়াতাড়ি আপনার সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এমনকি, এক সময়ে সফল হওয়ার চেষ্টা ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবণাও প্রবল।
অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়া:
এ ধরনের মানুষ খুব খুঁজে পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমাদের প্রায় সবার বন্ধু মহলেই এমন কেউ না কেউ থাকে, যে কখনো ব্যর্থতা স্বীকার করে না এবং করলেও তার দায় অন্যের উপর চাপানোর চেষ্টা করে। সবার সামনে তারা এ কাজটি করলেও মনে মনে তারা কষ্ট ভোগ করতে থাকে এবং ভাবে যে তাদের দ্বারা এই জীবনে কিছু করা সম্ভব নয়।
ভয়ংকর ব্যাপারটি হচ্ছে এটি একটি মানসিক রোগের পূর্বলক্ষণ এবং এই ধরনের চিন্তার ফলে ঐ ব্যক্তির চিন্তা চেতনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ক্রমশই কমে আসতে শুরু করে। যে কোন কাজের ক্ষেত্রে তারা অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে চায়, যাতে পরবর্তীতে খারাপ কিছু হলে তারা ঐ ব্যক্তির উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।
সামনে অগ্রসর না হওয়া:
ধরে নিন, এমন একটি সময়ে আপনার চাকরি চলে গেল, যখন আপনার টাকার খুব প্রয়োজন এবং আপনার পরিবার আপনার উপর নির্ভরশীল। এ রকম দু:সময়ে বহু মানুষের আত্মহত্যা করার উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো? জীবনে চলার পথে সবার সাথেই কম বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। তার মধ্যে কিছু এমনও ঘটনা থাকে যা আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে যায়।
সময়ের সাথে সাথে এসব ঘটনা ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। যারা এ ধরনের ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না, তাদের এই ঘটনাগুলি দুঃস্বপ্নের মত আপনাকে ধাওয়া করতে থাকে। জীবনের প্রতিটি কাজ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
সমালোচনা করা:
যারা নিজেরা সুখী থাকে না, তারা অন্য কারো সুখ সহ্যও করতে পারেন না এবং সব সময় অন্যের কাজের সমালোচনা করতে থাকেন। আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা সমালোচনার মাধ্যমে ঐ ব্যক্তিটির মনে একটি নেতিবাচক চিন্তা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন। কোন কিছুর মধ্যেই যেন তারা ভালো কিছু দেখতে পান না।
একটা কাজের বা সিদ্ধান্তের ভালো এবং মন্দ ফলাফল থাকতেই পারে এ সহজ কথাটি না বুঝে এবং ভালো দিকটির দিকে না তাকিয়ে খারাপ দিকটি নিয়ে বার বার তারা সমালোচনায় মেতে ওঠেন। কিছু কিছু ব্যক্তি এমনও আছেন, যারা নিজেদের সাথেও এমনটি করতে ছাড়েন না। নিজেকে প্রতিনিয়ত অন্য কারো সাথে তুলনা করতে থাকেন। একজন মানুষ যে অন্য একজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হন এবং সবার মধ্যে সব কাজ করার ক্ষমতা বা সামর্থ থাকে না, এটি তাদের বোধগম্য নয়।
ক্ষমা করতে না পারা:
ক্ষমা মহত্বের পরিচয় বহন করে, বহু আগেই থেকেই আমরা সেটা জানি। পৃথিবীর সব ধর্মেই ক্ষমার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে এবং ক্ষমার বহু উদাহরণ দেখানো হয়েছে। আপনার কোন বন্ধু যদি আপনার কোন ক্ষতি করে থাকে বা অন্যায় করে থাকে এবং আপনি যদি তাকে কোনভাবেই ক্ষমা করতে না পারেন, তাহলে ঐ ব্যক্তি সেই ঘটনাটি ভুলে গেলেও আপনি ভুলতে পারবেন না। এমনকি, এটি আপনার সুখ-শান্তিতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকবে প্রতিনয়ত।
আপনার যা করণীয় :
- কোন কিছু নিয়ে কখনোই নিশ্চিত থাকবেন না। ভালো ফলের আশা করুন পাশাপাশি সব সময় খারাপটির জন্যেও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে শিখুন।
- জীবনে যা কিছুই ঘটুক না কেন, আপনজনদের সাথে সেটি নিয়ে আলাপ করুন। অন্যর পরামর্শ নিন এবং তাদের মতের গুরুত্ব দেয়া শিখুন। কমপক্ষে সেটি নিয়ে ভাবুন।
- কখনোই অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনি যদি ভুল করে থাকেন তাহলে সেটি স্বীকার করে নেওয়ার মত সাহস রাখুন এবং ক্ষমা চেয়ে নিন।
- জীবনের চলার পথে সবকিছু ভালো হবে তা অবধারিত নয়। বরং ভালোর পাশাপাশি খারাপটাও হতে পারে, এটাই অবধারিত। যদি এমন কিছু হয়েই থাকে তাহলে সেটিকে মনে গেঁথে না রেখে সামনের দিয়ে অগ্রসর হয়ে যান।
- অন্যকে নিয়ে কথা বলার আগে সব সময় আগে নিজেকে বিবেচনা করুন যে ঐ ব্যক্তির জায়গায় আপনি থাকলে আপনি কতটুকু ভালোভাবে কাজটি করতে পারতেন। অন্যের কাজকেও সমানভাবে মূল্যায়ন করুন।
আমাদের জীবনে অসুখী হওয়ার কারণ প্রচুর। পাশাপাশি ভালো থাকার মতোও পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে। আপনি কোনটিকে বেছে নিয়ে কেমন থাকবেন এটি আপনার উপরেই নির্ভর করে। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, খারাপ দিকটা বেছে নিয়ে কখনো ভালো থাকা সম্ভব নয়। তাই উপরের স্বভাবগুলির মধ্যে কোনওটি যদি আপনার মধ্যে থেকে থাকে, তাহলে সেটিকে আজই বদলে ফেলুন এবং জীবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে নিন।
Leave a Reply