সুস্থ থাকতে হলে সুষম খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। প্রতিটি খাদ্য উপাদানের রয়েছে আলাদা আলাদা কাজ যা শরীর গঠনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এরকম একটি খাদ্য উপদান হচ্ছে জিংক যা শরীরের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় একটি খনিজ। এই খনিজের জন্যে জিংক সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার বিকল্প নেই।
এই খনিজটি যেসব খাবারে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়, সেগুলোতে যাওয়ার আগে আসুন জিংক সম্পর্কে যাবতীয় সব তথ্যের চুম্বক অংশগুলো সম্পর্কে জানা যাক-
জিংক কি?
জিংক একটি মিনারেল, দেহের জন্যে দারুণ দরকারি এক প্রকারের পুষ্টি। মানব দেহের জন্যে স্বল্প কিন্তু প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয়তার জন্যে একে “অ্যাজেনশিয়াল ট্রেস ইলেমেন্ট”-ও বলা হয়ে থাকে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন সেল জুড়ে জিংকের আধিপত্য থাকে যা আক্রমণকারি ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের হাত থেকে শরীরকে সর্বদা রক্ষা করে থাকে।
জিংকের কাজ কি?
জিংক আমাদের শরীরে ৩০০টিরও বেশী এনজাইমের কাজ পরিচালনায় সাহায্য করে থাকে। এগুলোর মাঝে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো-
- ক্ষত সারানো,
- ইমিউনিটি সিস্টেম উন্নত করা,
- পূর্নবয়স্কদের উর্বরতা বৃদ্ধি,
- শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি,
- প্রোটিন এবং ডিএনএ গঠন, ইত্যাদি।
জিংক আমাদের খাদ্যের স্বাদ নেওয়ার ক্ষমতা এবং ঘ্রানশক্তিও উন্নত করে।
জিংকের অভাবে যেসব শারীরিক সমস্যা হয়
মানবদেহে জিংকের ঘাটতি দেখা দিলে শারীরিক গঠন বাধাপ্রাপ্ত হয়। এমনকি, আরো অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন-
- চুল পড়া, ডায়রিয়া,
- চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া,
- ত্বক বিবর্ন হওয়া,
- ইমিউনিটি সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া, ইত্যাদি।
পরিমিত পরিমানে জিংকযুক্ত খাদ্য গ্রহন আপনাকে এ ধরনের সমস্যাগুলো থেকে মুক্ত রাখবে।
অতিরিক্ত জিংক গ্রহণে যেসব সমস্যা দেখা দেয়
তবে, মনে রাখবেন অতিরিক্ত জিংক জাতীয় খাদ্য গ্রহনেও আবার কিছু শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন-
- ডায়রিয়া,
- ক্ষুধামন্দা,
- মাথাব্যথা,
- স্থুলতার মত সাময়িক সমস্যা, ইত্যাদি।
তাই পরিমিত পরিমানে জিংক প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
কার কি পরিমাণ জিংক প্রয়োজন?
আমাদের শরীর অতিরিক্ত পরিমাণে জিংক সংরক্ষণ করে না বা সংরক্ষণ করতে পারে না। তাই, এটি অবশ্যই ডায়েটের অংশ হিসাবে খাদ্যের মাধ্যমে নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে। মেডিকেল সায়েন্সের মতে-
- একজন পূর্নবয়স্ক পূরুষের খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন ১১ মিলিগ্রাম জিংক থাকা উচিত।
- মহিলাদের ক্ষেত্রে এর পরিমান হওয়া উচিত ৮ মিলিগ্রাম।
- কিন্তু গর্ভবতী নারীদের প্রতিদিন অবশ্যই ১১ মিলিগ্রাম জিংক গ্রহন করা উচিত।
- আর যে সকল মহিলারা বাচ্চাদের বুকের দুধ পান করান, তাদের প্রতিদিন ১২ মিলিগ্রাম জিংক গ্রহন করা প্রয়োজন।
জিংক সমৃদ্ধ খাবার
সুপ্রিয় পাঠক, জিংক সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার পর নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা করছে যে, কোন ধরনের খাবারে জিংক রয়েছে?
আমরা আজকের আয়োজন সাজিয়েছি জিংক সমৃদ্ধ কিছু খাবারের তালিকা নিয়ে, যেগুলো প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখলে সহজেই জিংকের চাহিদা পূরন করতে পারবেন। চলুন দেরী না করে জিংক যুক্ত খাবারগুলো সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক-
১. মাংস – জিংকের মহা উৎস
মাংস জিংকের একটি সমৃদ্ধ উৎস। বিশেষ করে লাল মাংসে জিংকের পরিমান বেশী থাকে। কিন্তু অন্যান্য মাংস যেমন গরু, খাসি এবং মুরগিতেও জিংক পাওয়া যায়।
প্রতি ১০০ গ্রাম গরুর কাচা মাংসে ৪.৮ গ্রাম জিংক পাওয়া যায় যা প্রতিদিনকার প্রয়োজনীয় জিংক চাহিদার ৪৪% পূরন করে। ১০০ গ্রাম গরুর মাংসে অন্যান্য যে সকল খাদ্য উপদান রয়েছে তা হল-
- ১৭৬ ক্যালরি,
- ২০ গ্রাম প্রোটিন এবং
- ১০% ফ্যাট।
তবে, অতি মাত্রায় মাংস খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এটা শরীরে ফ্যাটের পরিমান বাড়িয়ে দেয় যা হার্টের অসুখ এবং ক্যান্সারের মত রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
এছাড়াও, মাংস অধিক মসলা দিয়ে রান্না করলে এর খাদ্যগুন নষ্ট হয়। তাই, জিংকের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন পরিমিত পরিমানে কম মসলায় রান্না মাংস খান।
২. সামুদ্রিক মাছ – জিংকের সমুদ্র
সামুদ্রিক মাছ জিংকের খুবই ভাল উৎস। তবে, সব মাছ নয়। বিশেষ কিছু মাছ এবং অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীতে প্রচুর পরিমাণে জিংক থাকে। যেমন-
- সামুদ্রিক ঝিনুক,
- চিংড়ি,
- কাকড়া, ইত্যাদি।
আর এগুলোর মধ্যে জিংকের সবচেয়ে ভাল উৎস হচ্ছে ঝিনুক। ৬টি মাঝারি সাইজের ঝিনুক প্রতিদিনের জিংক চাহিদার ২৯১% পূরন করে থাকে।
অবাক হচ্ছেন শুনে?
এর অর্থ প্রতিদিন ২টি ঝিনুক খেলেই প্রতিদিনের জিংকের চাহিদা সহজেই পূরন করতে পারবেন। এছাড়া, প্রতি ১০০ গ্রাম কাকড়াতে ৭.৬ মিলিগ্রাম ঝিনুক রয়েছে এবং মাঝারি সাইজের ১০০ গ্রাম চিংড়িতে প্রতিদিনের জিংক চাহিদার ১৪% সহজেই পূরন হবে। সুতরাং, জিংক সমৃদ্ধ খাবার হিসেবে সামুদ্রিক মাছ খেতে পারেন।
তবে, গর্ভবতী মহিলাদের সামুদ্রিক মাছ জাতীয় খাবার খাওয়ার পূর্বে এটা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে খাবারগুলো উচ্চচাপে ভালভাবে রান্না করা হয়েছে। কারণ, অনেক সময় সামুদ্রিক খাবার ভালভাবে রান্না না করা হলে ফুড পয়জনিং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৩. ডাল জাতীয় খাবার – জিংকের আধার
ডাল জাতীয় খাবারে প্রচুর পরিমাণে জিংক পাওয়া যায়। যার ফলে, এগুলোকে জিংকের আধার বলা হয়ে থাকে। আর এগুলো আমাদের দেশে সহজেই পাওয়া যায়। জিংকে জন্যে ডাল জাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে-
- মটরশুটি,
- মসুর ডাল এবং
- শিমের বিচি।
প্রতি ১০০ গ্রাম ডালে প্রতিদিনকার খাদ্য চাহিদার ১২% জিংক পাওয়া যায়।
যারা নিরামিষাশী অর্থাৎ যাদের মাংস খেতে সমস্যা আছে, তাদের জন্য এ জাতীয় খাবার থেকে প্রতিদিনের জিংক চাহিদা পূরন করা সহজ। এ জাতীয় খাবার প্রোটিন, ফাইবার এবং অন্যান্য খাদ্য উপাদানেরও ভাল উৎস।
৪. বীজজাতীয় খাদ্য – অনবদ্য জিংক সোর্স
বিভিন্ন শস্য বা সবজির বীজ থেকে ভাল পরিমান জিংক পাওয়া যায়। যেমন কুমড়ার বীজ, তিলের বীজ ইত্যাদি। আপনি যদি নিরামিষ খেতে পছন্দ করেন, তাহলে জিংকের চাহিদা পূরনে কুমড়ার বীজ খুব ভাল উৎস।
প্রতি আউন্স কুমড়ার বীজে আপনি ২.২ মিলিগ্রাম জিংক পাবেন যা একজন পূর্নবয়স্ক মহিলার প্রতিদিনের জিংক চাহিদার ২৮% পূরন করে। জিংক ছাড়াও ১ আউন্স কুমড়ার বীজ, তিলের বীজে আরো রয়েছে-
- ১৫৮ ক্যালরি,
- ১৩.৯ গ্রাম ফ্যাট,
- ২ মিলিগ্রাম সোডিয়াম এবং
- অন্যান্য খাদ্য উপাদান।
তাই, খাদ্য তালিকায় বীজ জাতীয় খাবার রাখা সুস্বাস্থ্যের জন্য খুবই দরকারী।
৫. বাদাম – জিংকে ভরপুর
বাদাম জিংকযুক্ত খাবারের চমৎকার একটি উৎস। কাজুবাদাম খেতে খুবই সুস্বাদু এবং সহজলভ্য। সকলেই কাজুবাদাম খেতে ভালবাসে, এটা কাচা এবং সেদ্ধ দুইভাবেই খাওয়া যায়। মাংসাসী এবং নিরামিষাশী উভয় ধরনের মানুষই কাজুবাদাম খেতে পারেন।
প্রতি এক আউন্স অথবা ২৮ গ্রাম কাজু বাদামে ১.৫ মিলিগ্রাম জিংক থাকে, যা একজন মহিলার প্রতিদিনের জিংক চাহিদার ২০% পূরন করে।
কাজুতে স্বাস্থ্যকর আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট রয়েছে। এটা ব্লাড প্রেসার কমাতে এবং স্বাস্থ্যকর এইচডিএল কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় কাজু বা বাদাম রাখুন। এটা শুধু জিংক নয়, ভিটামিন এ এবং ই এরও ভাল উৎস।
৬. দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধ এবং দুধজাতীয় খাবার যেমন দই, চীজ, মিষ্টি, ছানাতে পর্যাপ্ত পরিমান জিংক রয়েছে। এই খাবারগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমান প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রয়েছে যা হাড়, দাত এবং পেশী গঠনে সহায়তা করে।
শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের জন্য দুধ এবং দুগ্ধজাতীয় খাবার আবশ্যক। পুরুষদের পেশী গঠন, হাড় মজবুত এবং হজম শক্তি বাড়াতে দুগ্ধজাত খাদ্যের বিকল্প নেই।
প্রতি ৫০০ গ্রাম দুধে ২.৪০ মিলিগ্রাম জিংক রয়েছে, প্রতি ২৫০ গ্রাম দইয়ে রয়েছে ২.৩৮ মিলিগ্রাম জিংক রয়েছে৷ তাই, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় দুধ এবং দুগ্ধজাতীয় খাবার রাখুন। কেননা এটি জিংক সমৃদ্ধ খাবার এর সুপার সোর্স।
৭. ডার্ক চকোলেট – দারুণ উৎস জিংকের
ডার্ক চকোলেট খেতে কেনা ভালবাসে? এটা জিংকের একটি দারুন উৎস। প্রায় প্রতিদিনই স্ন্যাকসে আমরা ডার্ক চকোলেট খেয়ে থাকি, যা খাদ্যগুনেও ভরপুর। শুধু জিংকের অভাব দূর করাই নয়, ডার্ক চকলেটের দারুণ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে।
প্রতি ১০০ গ্রাম ডার্ক চকোলেটে রয়েছে ৩.৩ মিলিগ্রাম জিংক, যা প্রতিদিনের জিংক চাহিদার ৩০% পূরন করে। এছাড়াও, ১০০ গ্রাম চকোলেটে রয়েছে ৬০০ ক্যালরি এবং অন্যান্য আরো বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান।
এটি উচ্চ ক্যালরি সম্পন্ন একটি খাদ্য। তবে, অতি মাত্রায় ডার্ক চকোলেট খেলে রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং ওজন বেড়ে যেতে পারে। তাই পরিমিত মাত্রায় ডার্ক চকোলেট খান।
৮. শাকসবজি – স্বল্প মাত্রার জিংক
শাকসবজিতে জিংকের খুব ভাল উৎস নয়, কিন্তু কিছু কিছু শাকসবজিতে ভাল মাত্রায় জিংক রয়েছে। জিংক সমৃদ্ধ কিছু কিছু শাকসবজির মধ্যে রয়েছে-
- আলু,
- পেয়াজ কলি এবং
- সবুজ শিম।
একটি বড় আলুতে ১ মিলিগ্রাম জিংক পাওয়া যায় যা প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদার ৯% পূরন করে। শাকসবজি প্রতিদিনই খেতে পারেন, এতে স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হয় না।
উপসংহার
জিংক খুবই প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান এবং খনিজ এর ভাল উৎস। জিংক ব্যতীত খাদ্য তালিকা সুষম এবং সম্পূর্ন হতে পারে না৷ তাই, প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় নিয়মিত জিংক সমৃদ্ধ খাবার রাখুন। এটা আপনাকে স্বাস্থ্যবান হতে যেমন সাহায্য করবে, তেমনি বিভিন্ন অসুখ থেকে রক্ষা করবে যেগুলোর মাঝে রয়েছে-
- ঘ্রানশক্তি কমে যাওয়া,
- মাথাব্যথা,
- ডায়রিয়া,
- ইমিউনিটি পাওয়ার কমে যাওয়া,
- সঠিক গ্রোথ না হওয়া, ইত্যাদি।
তবে অতি মাত্রায় জিংক জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। আশা করি, জিংক গ্রহনের মাত্রা, উৎস এবং গ্রহনের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পোস্টটি আপনার উপকারে আসবে। জিংক নিয়ে লেখা এই পোস্টটি সম্পর্কে কোন প্রশ্ন বা মতামত দেওয়ার থাকলে আমাদের কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আমরা আপনার মতামত গুরুত্বসহকারে নিয়ে অবশ্যই দ্রুত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব, ইনশাল্লাহ্।
সাবিহা খানম says
ধন্যবাদ, আমার লেখাটি প্রকাশ করার জন্য।
Chandan says
জিংক নিয়ে যারপরনাই একটা দারুণ পোস্ট। তবে, সবাই যে সত্যিটা বলে এমন নয়। অনেকেই আছে যারা ভুয়া পোস্ট দেয়।
জেসিকা জেসমিন says
ধন্যবাদ, চন্দন। আমাদের এখানে কেউ ভুয়া পোস্ট দেয় না, আশা করি আপনি সেটা জেনেছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের প্রিয় লেখিকা সাবিহা খানমের লেখাটি পড়ার জন্যে।