যেসব খাবার হিমোগ্লোবিন বাড়ায় সেগুলো আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতেই রয়েছে। রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে খাবার, বিশেষ করে প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার বিকল্প নেই। ভিটামিন বা আয়রন পিল না নিয়ে খাবার খেয়েই রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানো যায়। ঔষধের কিছু না কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকেই, কিন্তু প্রাকৃতিক খাবারের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া একেবারেই নেই।
রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার কিছু কারণ রয়েছে যেগুলো আমাদের সকলেরই জেনে রাখা দরকার। কারণ, রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়, শারীরিক দূর্বলতা পরিলক্ষিত হয়, মাথা ব্যথা করে, মাথা ঘোরে, হার্টবিট বেড়ে যায় এবং অনেক সময় হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কাজেই, আমাদের প্রত্যেকেরই রক্তে যথেষ্ট্য পরিমাণ হিমোগ্লোবিন থাকা চাই।
রক্তে সঠিক মাত্রায় হিমোগ্লোবিন না থাকলে শরীরে সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি দেখা দেয় সেটি হচ্ছে অক্সিজেন স্বল্পতা। কারণ, আমাদের শরীরের আয়রণ সমৃদ্ধ এই প্রয়োজনীয় প্রোটিনটি অক্সিজেন পরিবহন করে থাকে। ফলে শরীরের কোষগুলো কার্যকর হয়, সচল থাকে। সেই সাথে, কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হয়ে যাওয়ার কারণে শরীর সব সময় ঝরঝরা থাকে।
কাজেই, শরীরের জন্যে যেমন রক্তের প্রয়োজন, তেমনই রক্তে হিমোগ্লোবিন প্রয়োজন। আর হিমোগ্লোবিন জন্যে প্রয়োজন প্রাকৃতিক খাবার যা আমাদের চারপাশে খুব সহজেই পাওয়া যায়। আসুন, সেই খাবারগুলো সম্পর্কে জানি যেগুলো রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে।
যেসব খাবার হিমোগ্লোবিন বাড়ায়
রক্তে হিমোগ্লোবিনের সঠিক পরিমাণ বজায় থাকা জরুরী। আর সঠিক পরিমাণের জন্যে প্রয়োজন সঠিক খাবার। যেসব খাবারে প্রচুর পরিমাণে আয়রণ, ফোলেট ও ভিটামিন সি রয়েছে সেসব খাবারই মূলত হিমোগ্লোবিন বাড়ায়। নিচে এমন ১০টি খাবার সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ সব সময় সঠিকভাবে বজায় রাখে।
১. মাংশ রক্তে হিমোগ্লিবন বাড়ায়
এটি সকলেরই জানা এবং মেডিকেল সায়েন্স দ্বারা প্রমাণিত যে, মাংশ, বিশেষ করে লাল মাংশ আয়রণের একটি বড় উৎস। আর আমরা সকলেই জানি যে আয়রণ হচ্ছে রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর হাতিয়ার। বিভন্ন ধরণের মাংশ সহায়তা করে শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-
- লিভার: আয়রণ, ভিটামিন বি১২ এবং ফোলেটের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে লিভার। এর মাঝে ছাগলের লিভারে সবচেয়ে বেশি বি১২ ভিটামিন রয়েছে যার পরিমাণ প্রতি ১০০ গ্রামে ৮৫.৭ মিলিগ্রাম। এছাড়াও এটিতে প্রচুর পরিমাণে ফোলেট, আয়রন ও ভিটামিন সি রয়েছে যার পরিমাণ প্রতি ১০.২ গ্রামে ৪০০ মিলিগ্রাম।
- চর্বিহীন গরুর মাংশ: চর্বি ছাড়া গরুর মাংশ আয়রণের আরও একটি দুর্দান্ত উৎস। প্রতি ৮৫ গ্রাম গরুর মাংশে ২.১ গ্রাম আয়রণ রয়েছে যা হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে উৎকৃষ্ট ভূমিকা পালন করে থাকে।
- মুরগীর সিনার মাংশ: পর্যাপ্ত আয়রণ সোর্স হিসেবে আরেকটি খাবার হচ্ছে মুরগীর সিনার মাংশ। প্রতি ১০০ গ্রাম মুরগীর মাংশে, বিশেষ করে সিনার মাংশে আপনি কমপক্ষে ০.৭ মিলিগ্রাম আয়রণ পাবেন যা আপনার শরীরে হিমোগ্লোবিনের সঠিক মাত্রা বজায়ে সহায়তা করবে।
২. ফলমূল হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে
ফলমূলে প্রচুর ভিটামিন আছে যার মাঝে হিমোগ্লিবিনের জন্যে দরকারি ভিটামিন বি১২, ভিটামিন সি এবং আয়রণ পাওয়া যায়। সব ফলই শরীরের সুস্থ্যতার জন্যে ফলপ্রসু, তবু শুধু মাত্র যেসব ফল হিমোগ্লিবন বাড়ায় সেগুলো নিচে দেয়া হল-
- কমলা: কমলায় রয়েছে প্রচুর ভিটামিন সি যা আয়রণের কম্বিনেশনে রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদন করে।
- লেবু: ভিটামিন সি এর সিম্পল উৎস যে লেবু তা আমরা সবাই জানি। আর স্বল্প পরিমাণেও হলেও এটিতে রয়েছে আয়রণ। ভিটামিন সি আর আয়রণের মিলিত কার্যক্রমে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বজায় থাকে আমাদের সবার শরীরে।
- স্ট্রবেরি: ভিটামিন সি ও সিম্পল আয়রণের আরেকটি উৎস হচ্ছে স্ট্রবেরি।
- আপেল: রক্তে হিমোগ্লোবিনের নরমাল লেবেল বজায় রাখতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে একটি সাধারণ আপেল। অন্যান্য পুষ্টির সাথে আপেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রণ যা হিমোগ্লিবিনকে শরীরে গ্লোবালাইজ করে থাকে।
- ডালিম: শুধু আয়রণই নয়, ডালিমে আছে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফাইবার এবং আরো অনেক ভিটামিন ও মিনারেল। কাজেই, যাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম, তাদের প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ গ্রাম ডালিম খাওয়া উচিৎ যা ০.৩ মিলিগ্রাম আয়রণের ঘাটতি পূরণ করবে।
এছাড়াও, প্রায় সব ফলেই, বিশেষ করে রসালো ফলগুলিতে কিছু না কিছু আয়রণ রয়েছে। কাজেই, যেসব খাবার হিমোগ্লোবিন বাড়ায় সেগুলোর মাঝে রসালো ফল হিসেবে আরো রয়েছে আম, তরমুজ, বেদানা, ইত্যাদি।
৩. শাক-সবজি বাড়ায় রক্তের শ্বেতকণিকা
পর্যাপ্ত পুষ্টি আর ভিটামিনের ভান্ডার হিসেবে শাক-সবজি সব সময়ই ডাক্তারদের পরামর্শের তালিকার শীর্ষে থাকে। শাক-সবজিতে থাকা আয়রণ রক্তে রঙিন হিমোগ্লোবিন বাড়ায়।
- পালং শাক: আপনি যদি নিজের শরীরে হিমোগ্লোবিন বাড়াতে চান, তবে প্রচুর পরিমাণে পালং শাক খান। কারণ, এতে রয়েছে যথেষ্ট্ পরিমাণে আয়রণ যা হিমোগ্লোবিন বাড়ানোর পাশাপাশি আপনার যৌণ স্বাস্থ্যকেও ভাল রাখবে। প্রতি ১০০ গ্রাম পালং শাকে আছে ৪ মিলিগ্রাম আয়রন।
- ব্রোকলি: রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে ব্রোকলি বেশ উপকারি একটি সবজি। কারণ, এটি আয়রণের একটি দারুণ উৎস। আয়রন ছাড়াও ব্রোকলিতে আছে প্রচুর পরিমাণে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি। যেমন ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন এ এবং সি। প্রতি ১০০ গ্রাম ব্রোকলিতে আছে ২.৭ গ্রাম আয়রণ।
- বিটরুট: হিমোগ্লোবিনের জন্যে প্রয়োজনীয় ফোলেটের একটি বিরাট উৎস হচ্ছে বিটরুট। এটি একই সাথে আয়রণ ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ একটি পুষ্টিকর সবজি। প্রতি ১০০ গ্রাম বিটরুটে আছে ০.৪ মিলিগ্রাম আয়রণ।
- আলু: আলুতেও আছে আয়রণ, আছে ভিটামিন সি যা হিমোগ্লোবিনের জন্যে প্রতিদিনই প্রয়োজন। একটি বড় আলুতে প্রায় ৩.২ মিলিগ্রাম আয়রন থাকে। সুতরাং, আলু খান, আয়রন পান ও হিমোগ্লোবিন বাড়ান।
৪. সামুদ্রিক খাবার
প্রতিদিন আমাদের শরীরে যতটুকু আয়রন এবং ভিটামিন বি১২ প্রয়োজন তার প্রায় সবটুকুরই যোগান দিতে পারেন ক্ল্যাম, ঝিনুক এবং ক্যাভিয়ারের মতো সামুদ্রিক খাবার।
৫. শাপলা এবং শস্য
শাপলা এবং শস্য জাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে সয়াবিন, মটরশুটি এবং ছোলা্। শস্য, যেমন সয়াবিনে রয়েছে প্রচুর আয়রণ যা শরীরের ঘাটতি পূরণে সহায়ক। সয়াবিনে শুধু আয়রণই নয়, রয়েছে ফোলেটও যা পর্যাপ্ত পরিমাণে দরকার হিমোগ্লোবিনের জন্যে। সেই সাথে, ব্রাউন রাইসেও আছে আয়রন ও ভিটামিন সি যেখানে প্রতি ১০০ গ্রামে পাবেন ০.৪ গ্রাম আয়রণ।
৬. কলাই জাতীয় ডাল
আপনি যদি আপনার দৈনন্দিন ডায়েট চার্টে পর্যাপ্ত আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার রাখতে চান, তবে কলাই জাতীয় সব ধরণের ডাল রাখুন।
৭. ঝিনুক
আয়রনের একটি উচ্চ মাত্রার উৎস হচ্ছে ঝিনুক যা সামুদ্রিক খাবার হিসেবেই গণ্য হয়। প্রতি ১০০ গ্রাম ঝিনুকে পাবেন ২৮ মিলিগ্রাম আয়রণ, ২২.১ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং ৯৮.৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি১২।
৮. শস্যদানা
বার্লি, কুইনোয়া এবং ওটমিলের মতো শস্যদানাও আয়রন সমৃদ্ধ খাবার। প্রতি ১০০ গ্রাম শস্যদানায় আয়রণের পরিমাণ ২.৫ মিলিগ্রাম।
৯. শুকনো ফল
কিসমিস, এপ্রিকট ও খেজুরের মতো শুকনো ফলগুলোতে রয়েছে অনেক আয়রণ। আয়রণের নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে এ জাতীয় শুকনো ফল খেতে পারেন হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়ানোর জন্যে। জেনে রাখুন প্রতি ১০০ গ্রাম শুকনো ফলে আছে ০.৮ মিলিগ্রাম আয়রণ। আর আয়রণ ছাড়াও এ ধরণের শুকনো ফলে আরো রয়েছে প্রয়োজনীয় ফাইবার ও ভিটামিন।
১০. অন্যান্য খাবার
হিমোগ্লোবিনের জন্যে প্রয়োজনীয় আয়রণ, ভিটামিন সি ও ফোলেটের পর্যাপ্ত উৎস হিসেবে আরো নানা রকম খাবার রয়েছে। সেসব খাবারের মধ্যে খেতে পারেন, ডিম, কুমড়োর বিচি, বাদাম, ডার্ক চকলেট, ইত্যাদি।
শেষ কথা
আপনি হয়তো আগে থেকেই জানেন যে হিমোগ্লোবিন কি আর এর কাজ কি। আজ জানলেন রক্তে যেসব খাবার হিমোগ্লোবিন বাড়ায় সেগুলো সম্পর্কে। এগুলোর বাইরেও আরো অনেক খাবার রয়েছে যেগুলো পর্যাপ্ত আয়রন, ফোলেট ও ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। তবে, আপনাকে যে প্রতিদিন সব খাবারই খেতে হবে, এমন নয়। এ তালিকা থেকে আপনি আপনার পছন্দের খাবারগুলিই খেতে পারেন। আর হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি পূরণের জন্যে এইসব প্রাকৃতিক খাবার আপনার চারপাশেই পাওয়া যাবে।
Leave a Reply