ফ্যাশন ডিজাইন কি অর্থাৎ এর সংজ্ঞা জানা না থাকলেও মোটামুটি সবাই এটা বোঝেন। আর ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার ইচ্ছে থাকে অনেকেরই। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশ ও সঠিক গাইডলাইন না পাওয়ার কারণে ইচ্ছে থাকা সত্বেও অনেকেই ফ্যাশন ডিজাইনার হতে পারেন না।
আজ আপনাদের জানাবো কিভাবে আপনি আপনার ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার ইচ্ছেটাকে বাস্তবে রূপ দেবেন। তার আগে ফ্যাশন ডিজাইনটা আসলে কি সেটা একবার জেনে নেয়া যাক।
ফ্যাশন ডিজাইন কি?
ফ্যাশন ডিজাইন এমন একটা আর্ট বা শিল্প যার মাধ্যমে জামা-কাপড় ও এর অ্যাক্সেসোরিজের উপর ডিজাইন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ও নান্দনিকতা প্রয়োগ করা হয়। ফ্যাশন ডিজাইনের ধরণ ও প্রক্রিয়া মূলত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত।
অর্থাৎ, একটা সমাজের চলমান ধারার উপর ডিফেন্ড করে যে ট্রেন্ড দাঁড়িয়ে যায়, সেটাই ফ্যাশন ডিজাইন। আর এটাকে ডিজাইনারা মূলত কাপড়ে কিংবা অ্যাক্সেসোরিজে ফুটিয়ে তোলেন।
ফ্যাশন ডিজাইনের প্রকারভেদ
ফ্যাশন ডিজাইনের বিভিন্ন প্রকার বা ফর্ম রয়েছে। সবচেয়ে পরিচিত ফর্ম হচ্ছে অ্যাপারেল যার অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে ক্লথিং ও গার্মেন্টস্। আর এই ফর্মের দুটি প্রধান বিভাগ আছে। প্রথম এবং সর্বাধিক মর্যাদাপূর্ণটি হচ্ছে হিউট কৌচার যা নির্দিষ্ট ধনী ব্যক্তিদের জন্য তৈরি এক ধরণের দামী পোশাক।
হিউট কৌচার শব্দটি ফ্রেঞ্চ এবং এটি প্যারিসের প্রধান বা নামী-দামী ফ্যাশন দৃশ্যের সাথে সম্পর্কিত। বিশেষত, হিউট কৌচারে কাজ করা ফ্যাশন ডিজাইনারদের প্যারিসে ওয়ার্কশপ রয়েছে। প্রতি সিজনে প্যারিস প্রেসে এই ডিজাইনারা মডেলের মাধ্যমে দু’টি রানওয়েতে তাদের ডিজাইন শো করে থাকেন।
আরেক ধরণের ফ্যাশন ডিজাইন হচ্ছে prêt-a-porter। এটাও একটি ফ্রেঞ্জ শব্দ, পাশ্চত্যে যাকে ready-to-wear বলা হয়। এই ধরণের ফ্যাশন ডিজাইন সব ধরণের মানুষের জন্যে। Ready-to-wear মূলত কোয়ালিটি ক্লথিং কিন্তু এটির ডিজাইন ফ্যাক্টরিতে আর এটির স্ট্যান্ডার্ড সাইজ থাকে।
অন্যান্য ফ্যাশন ডিজাইনের মধ্যে রয়েছে সু ডিজাইন। ক্যাজুয়াল, অ্যাথলেটিক এবং ফর্মাল – এই ধরণের সু ডিজাইন রয়েছে। এছাড়াও, স্কার্প, জুয়েলারি, হ্যান্ডব্যাগসহ আরো কিছু ফ্যাশন ডিজাইন রয়েছে।
ফ্যাশন ডিজাইনার কাকে বলে?
আপনি কি কখনো নিজের জামা-কাপড় কিংবা অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিস-পত্র ডিজাইন করেছেন? কখনো কি ভেবেছেন কিভাবে একটি নতুন ধরণের জামা তৈরি করা যায়? কিংবা ভেবেছেন কি কিভাবে একজন ইউনিক ডিজাইনের জুতা কিংবা একটা হাত ব্যাগ তৈরি করা যায়? বলতে পারেন যে, এটা তো আমার কাজ নয়, আমার কাজ হচ্ছে পরিধান করা।
হুম, আপনি ঠিকই বলেছেন, এটা আপনার কাজ নয়। এটা যার কাজ, তিনিই একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। সহজ ভাষায় যিনি ফ্যাশন ডিজাইন করেন, তিনি ফ্যাশন ডিজাইনার।
একজন ফ্যাশন ডিজাইনার ব্যক্তির মধ্যে কোনও স্পেসিফিক লুক তৈরির জন্যে ফেব্রিক, শেপ, কালার, ট্রিমিং এবং অন্যান্য অ্যাসপেক্টের সমন্বয়ে ডিজাইন করে থাকেন। প্রথমেই তাকে ব্যক্তির একটি বিশেষ লুক আনার জন্যে আইডিয়া জেনারেট করতে হয়, এরপর সেটাকে স্কেচের মাধ্যমে ডিজাইনে রূপ দিতে। পরবর্তীতে সেটি প্যাটার্ন মেকারের হাতে যায় এবং সবশেষে গার্মেন্টস্ ফ্যাক্টরিতে গিয়ে তার ডিজাইনটি বাস্তবতা পায়। যে কোনও ফ্যাশনের মূল কারিগরই হচ্ছে ফ্যাশন ডিজাইনার।
কিভাবে ফ্যাশন ডিজাইনার হবেন?
স্কুল-কলেজ থেকেই প্রস্তুতি নিন
ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার জন্যে সৃষ্টিশীলতা প্রয়োজন। আর এই সেক্টরে সৃষ্টিশীলতার শুরুতেই রয়েছে কালার এন্ড শেপ। কালার চেনা ও শেপ বোঝার জন্যে আপনার অবশ্যই ভাল দৃষ্টিশক্তি থাকতে। এ দৃষ্টিশক্তি চোখের পাওয়ার নয়, বরং অন্তরের পাওয়ার যা দিয়ে আপনি কালার ও শেপ চেনার পাশাপাশি বাইরের জগতের ফ্যাশন ট্রেন্ড বুঝতে পারবেন।
আর এটার জন্যে আপনার স্কুল এবং কলেজ থেকে প্রস্তুতি নেয়াই ভাল হবে। অর্থাৎ, পড়াশুনার এই সময়টা থেকেই আঁকা-আঁকির অভ্যাশ করুন। আঁকা ও রং করার আপনাকে কালার বোঝা ও প্যাটার্ন তৈরিতে দক্ষ করে তুলবে।
স্কুল-কলেজ থেকেই ফ্যাশন ডিজাইন রিলেটেড বিভিন্ন বই পড়ুন। ফ্যাশন ডিজাইনের উপর প্রচুর অনলাইন ম্যাগাজিন রয়েছে। ফেসবুকে সময় নষ্ট না করে এ ধরণের ম্যাগাজিনগুলোতে সময় ব্যয় করুন। পাশাপাশি, কিছু ভিজ্যুয়াল ডিজাইন সফটওয়্যারের ব্যবহার শিখে নিন। বিশেষ করে, এই ৫টি ফ্রি ফ্যাশন ডিজাইন সফটওয়্যার থেকে যে কোনটি শিখে নিন এবং নিয়মিত প্র্যাকটিস করুন।
ফ্যাশন ডিজাইন ডিগ্রি নিন
ফ্যাশন ডিজাইনের উপর পড়াশুনা করুন, ডিগ্রি নিন। আজকাল অনেক ইউনিভার্সিটিতেই ফ্যাশন ডিজাইনের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রোগ্রাম রয়েছে। হাইয়ার সেকেন্ডারি সার্টিফিকেট কোর্স বা এইচএসসি শেষ করে সম্ভব হলে অন্য বিষয়ে না পড়ে ফ্যাশন ডিজাইনে ভর্তি হোন।
আমাদের দেশের সেরা ১০টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে ফ্যাশন ডিজাইন রয়েছে। ভাল করে খোঁজ নিয়ে এগুলোর যে কোনটিতে ভর্তি হতে পারেন। মনে রাখবেন, ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এখন বেশ প্রতিযোগীতামূলক। কাজেই, যার ফ্যাশন ডিজাইনের উপর ডিগ্রি থাকবে, সে নিশ্চয়ই অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবে।
অনলাইনে ফ্যাশন ডিজাইন কোর্স করুন
আপনি যদি ইতিমধ্যেই অন্য বিষয়ে পড়া-শুনা শেষ করে থাকেন, কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনেই ক্যারিয়ার গড়তে চান, তবে এই ৫টি ফ্রি ফ্যাশন ডিজাইন কোর্স থেকে যে কোনটি করে নিতে পারেন। কিংবা সময় থাকলে এবং আপনার আগ্রহের যদি কমতি না হয়, তবে সবগুলোই শেষ করতে পারেন। কারণ, এই কোর্সগুলো ছোট ছোট, কোনটি ১৫ ঘন্টার, কোনটি ২ সপ্তাহের।
আর আপনি যদি ইতিমধ্যেই ফ্যাশন ডিজাইনের উপর ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জণ করে থাকেন, তবু এই কোর্সগুলো আপনার কাজে লাগবে। কারণ, কোর্সগুলো পরিচালনা করছেন বিশ্বের অনেক নামী-দামী ফ্যাশন ডিজাইনরা। কাজেই, এই কোর্সগুলো আপনাকে দক্ষ হতে সাহায্য করবে।
বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জণের চেষ্টা করুন
আপনি হয়তো ফ্যাশন ডিজাইনে ডিগ্রি নিয়েছেন কিংবা এর উপর কিছু কোর্সও করেছেন, তবু আপনি এখন পর্যন্ত ক্যারিয়ার গঠনের জন্যে পুরোপুরি তৈরি নন। আপনার এখন বাস্তব অভিজ্ঞতা লাগবে। কাজেই, আইডিয়া থেকে ডিজাইন এক্সিকিউট করা এবং সবগুলো ধাপ পেরিয়ে ফাইনাল্লি প্রোডাকশনে যাওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কাজের অভিজ্ঞতার জন্যে যে কোনও ডিজাইন ফার্ম, কিংবা ম্যানুফ্যাকচারিং হাউজে কাজ শুরু করুন।
বিভিন্ন বায়িং হাউজ প্রায়ই প্রেশ-হ্যান্ড অ্যাম্পোয়ী নিয়ে থাকে। বেতন যদি খুবই সামান্যও হয়ে থাকে, তবু অভিজ্ঞতা অর্জণ ও নিজেকে দক্ষ করে তোলার জন্যে জয়েন করে ফেলুন।
লিংকডইন অ্যাকাউন্ট খুলুন
জেনে নিন যে-সব কারণে আপনার একটি লিংকডইন অ্যাকাউন্ট থাকা দরকার। আশা করি, লিংকডইন অ্যাকাউন্ট থাকার গুরুত্ব বুঝেছেন এবং আজই একটি খুলে নেবেন। ফ্যাশন ডিজাইনের উপর আপনার এ যাবৎকালের সকল পড়াশুনা এবং কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে লিংডইন অ্যাকাউন্টি সাজিয়ে নিন। এটি আপনার পোর্ট-ফোলিও হিসেবে কাজ করবে এবং আপনাকে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ুন
ফ্যাশন ডিজাইনে সফল হতে হলে আপনাকে অবশ্যই সফলদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে হবে। আপনার সঙ্গে যারা এ বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন, তাদের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রাখুন। বিশেষ করে, ভার্সিটিতে যাদের সঙ্গে ফ্যাশন ডিজাইনে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন, তাদের সঙ্গে যেন যোগাযোগের ঘাটতি তৈরি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
এছাড়াও, যেখানে যত ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে পরিচয় হবে, সবার নাম্বার নিয়ে রাখুন; সবার সাথে ফেসবুক ও লিংকডইনসহ সকল সোশ্যাল মিডিয়ায় কানেক্টেড থাকুন। মনে রাখবেন, যে কোন সেক্টরে সফলতার জন্যে সার্কেল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আশা করি, ফ্যাশন ডিজাইন কি সে বিষয়ে বিস্তারিত জেনেছেন। ফ্যাশন ডিজাইনার কাকে বলে এবং ফ্যাশন ডিজাইনারের কাজ কি, সে-সব সম্পর্কে ধারণা পেয়েছেন। আর সবচেয়ে জরুরী বিষয়, কিভাবে ফ্যাশন ডিজাইনার হবেন, সেটাও বিশদভাবে জেনেছেন। এবার, উপরোক্ত পরামর্শগুলো মেনে চলুন আর একজন দক্ষ ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে উঠুন।
Rakib says
ফ্যাশন ডিজাইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেলাম। আশা করি, যারা ফ্যাশন ডিজাইনার হতে চান, তাদের জন্যে এই লেখাটি খুব উপকারে আসবে।