কম্পিউটারের নাম নিলে কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের নাম নিতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা, কম্পিউটার চালু করার অন্যতম নিয়ামক হল, অপারেটিং সিস্টেম। কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের নাম কমবেশি সবাই শুনেছেন।
বর্তমানে অবশ্য শুধু কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম বললে ভুল হবে, বরং বর্তমানে মোবাইলের জন্য, এমনকি টিভির জন্য আলাদা অপারেটিং সিস্টেম রয়েছে। সুতরাং, এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সম্পর্কে যদি আপনার আইডিয়া না থাকে তাহলে, এই লেখাটি আপনার জন্য।
আজকের এই লেখায় আমরা, অপারেটিং সিস্টেম কি? অপারেটিং সিস্টেম কত প্রকার ও কি কি? এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব। আমি চেষ্টা করবো, গতানুগতিক বইয়ের ভাষা থেকে বের হয়ে, একদম সহজভাবে উদাহরণসহ বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেয়ার।
অপারেটিং সিস্টেম কি?
কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম হল এমন একটি সফটওয়্যার সিস্টেম যা কম্পিউটারের সকল যন্ত্রাংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। অপারেটিং সিস্টেম হার্ডওয়ার অর্থাৎ আপনার কম্পিউটারের যে যন্ত্রপাতি আছে সেগুলোর সাথে যোগাযোগ করে।
একটা সেলাই মেশিন চালানোর জন্য দর্জির প্রয়োজন হয়। আর, সেলাই মেশিনের অপারেটিং সিস্টেম হল দর্জি। দর্জি সেলাই মেশিনকে নির্দেশনা দেয়, আবার কাপড়কেও ঐ-মোতাবেক পরিচালনা করে। সর্বশেষ, একটা জামাতে রূপান্তর করে। কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম এই একই কাজ করে।
একটু সহজ ভাষায় বলি, এই মুহূর্তে আপনি চাচ্ছেন একটি গান শোনার জন্য। সে ক্ষেত্রে, আপনি মিডিয়া প্লেয়ারে বা কাঙ্ক্ষিত গানটিতে ক্লিক করে চালু করবেন। আর এই কাজটি করার পর, আপনার গানটি বেজে উঠবে। এখন প্রশ্ন হল, এই যে কাজগুলো কিভাবে হলো?
কাজগুলো হয়েছে অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে।
অপারেটিং সিস্টেমের মধ্যে কার্নেল নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কাজ করে। কার্নেল এখানে কাজ করে বিয়ের ঘটকের মতো, পাত্র-পাত্রীর মধ্যে যোগসূত্র করিয়ে দেয়ার।
এই যে আপনি mp3 গানটা চালু করলেন, এই গানটা চালু করার বিষয়টা কিন্তু আপনার মেশিন বুঝতে পারেনি। কারণ, কম্পিউটারের ভাষা; বাইনারি সংখ্যা। মেশিনকে বোঝানোর দায়িত্বটা ছিল কার্নেলের। কার্নেল অপারেটিং সিস্টেমের থেকে নির্দেশ পাওয়ার পর সেটা হার্ডডিস্ক, স্পিকার, প্রসেসর সর্বত্র ছড়িয়ে দেয় এবং বলে দেয় গানটি চালু করার জন্য।
যন্ত্রাংশ তার কাজগুলো করে কার্নেলকে বলে দেয়, হ্যাঁ আমি আমার কাজ করেছি। কার্নেল আবার অপারেটিং সিস্টেমকে বলে তারা কাজটি করেছে, তখন অপারেটিং সিস্টেমে আমাদের ফলাফলটি মনিটরে প্রদর্শন করে। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় কয়েক মিলি সেকেন্ডেরও কম সময়ে। তবে, যাদের প্রসেসর, রেমের ক্ষমতা কম তাদেরটা খানিকটা দেরি হয়।
এছাড়া, কম্পিউটার চালু করার সময় আমরা যখন কম্পিউটার চালু করি, তখন সরাসরি কম্পিউটারের প্রসেসর, মাদারবোর্ড, হার্ডডিস্ক চালু হয়ে যায় এবং তারা কার্নেলকে সংকেত দেয়। তারপর, কার্নেল আবার অপারেটিং সিস্টেমকে মনিটরে ডিসপ্লে করতে নির্দেশ দেয়। এইভাবে কম্পিউটার চালু হয়।
এই আলোচনার পর আশা করি, অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে সামান্য কিছু ধারণা হয়েছে। এখন প্রশ্ন করতে পারেন ভাই, অপারেটিং সিস্টেম ছাড়া কি কম্পিউটার চালানো সম্ভব নয়?
সোজাসাপ্টা উত্তর- হ্যাঁ, সম্ভব।
সেই প্রাচীনকালের কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম ছাড়াই চলতো। তবে, সমস্যা ছিল। আমরা যেমন আজকাল মনিটরের সামনে কীবোর্ড, মাউসে ক্লিক করার মাধ্যমে সবকিছু খুব দ্রুত কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই করে ফেলি, প্রাচীনকালে কম্পিউটারগুলোতে এরকম ছিল না। এরকম এক ক্লিকে সব তথ্য পাওয়া যেত না। তখনকার সকল কাজ মানুষকে ম্যানুয়ালি করতে হতো।
আর, তাই বর্তমান সময়ের অপারেটিং সিস্টেমগুলোকে GUI তথা গ্রাফিকাল ইউজার ইন্টারফেস বল হয়।
অপারেটিং সিস্টেম কত প্রকার ও কি কি?
অপারেটিং সিস্টেমের প্রকারভেদের কথা বললেই আমাদের মাথায় ৪ ধরণের প্রকারের কথা আসে।
৪ প্রকারের অপারেটিং সিস্টেম হলো-
- উইন্ডোজ
- ম্যাক ওএস
- লিনাক্স
- অ্যান্ড্রয়েড
- আইওএস
সত্যি বলতে, এইগুলো অপারেটিং সিস্টেমের প্রকারভেদ নয়, তবে প্রকারভেদের অংশ, যা লেখার বাকি অংশ পড়লেই বুঝতে পারবেন। আবার, লিনাক্স কিন্তু অপারেটিং সিস্টেম নয়, বরং এটা একটি কার্নেল। আর এই কার্নেলের মাধ্যমেই তৈরি হয় অপারেটিং সিস্টেম। লিনাক্সের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা জনপ্রিয় কিছু অপারেটিং সিস্টেম হল, উবুন্টু, ডেবিয়ান, আর্চ, কালি লিনাক্স ইত্যাদি।
অপারেটিং সিস্টেম আসলে ৬ প্রকার। যথা:
- রিয়েল টাইম ওএস
- মাল্টিটাস্কিং / টাইম শেয়ারিং ওএস
- মোবাইল ওএস
- ব্যাচ অপারেটিং সিস্টেম
- ডিস্ট্রিবিউটেড ওএস
- নেটওয়ার্ক ওএস
১. রিয়েল টাইম ওএস
রিয়েল টাইম হল একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করার নিশ্চয়তা দেয়। এই ধরণের অপারেটিং সিস্টেম সাধারণত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট, ট্রাফিক কন্ট্রোল, রোবট কিংবা মিসাইল পরিচালনার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই ধরণের অপারেটিং সিস্টেমে ত্রুটি থাকে না এবং কাজ অনেক দ্রুত সমাধান করতে পারে।
উদাহরণ: RTX, VxWorks, Windows CE, DSP/BIOS ইত্যাদি।
২. মাল্টিটাস্কিং / টাইম শেয়ারিং ওএস
টাইম শেয়ারিং ওএসে একাধিক ইউজার একাধিক প্রোগ্রাম চালাতে পারে। একটা সিপিউদিয়ে একাধিক প্রোগ্রাম চালানোর ফলে, সিপিউর সঠিক ব্যবহার হয়।
টাইম শেয়ারিং ওএসের উদাহরণ: Windows 7,8,10, MAC OS, Multics, Unix ইত্যাদি।
৩. মোবাইল ওএস
মোবাইল ওএস সাধারণত, স্মার্ট-ফোন বা ট্যাবলেটের মত ডিভাইসের জন্য ডিজাইন করা। যদিও, কম্পিউটার প্রসেসর ও মোবাইল প্রসেসরের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথম দিকে, মটোরলা লিনাক্সের উপর ভিত্তি করে মোবাইলের জন্য অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করে।
তারপর, নোকিয়া যখন সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে আসে, তখন থেকে মোবাইল ওএসের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর বর্তমানের অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস এই জনপ্রিয়তাকে আকাশচুম্বী করেছে।
উদাহরণ: অ্যান্ড্রয়োডে, আইওএস, সিম্বিয়ান ইত্যাদি।
৪. ব্যাচ অপারেটিং সিস্টেম
কিছু কম্পিউটার আছে যাদের কাজ-কারবার খুব ধীরগতির এবং সময়সাপেক্ষ। আর, এই টাইপের কম্পিউটারের গতি বাড়ানোর জন্য ব্যাচ অপারেটিং সিস্টেম।
এই ধরণের অপারেটিং সিস্টেম সরাসরি কম্পিউটারের সাথে ইন্টারএক্ট করে না। এখানে, অপারেটর একই রকম কাজগুলোকে একটি ব্যাচে গ্রুপ করে কাজ পরিচালনা করে। অপারেটরের দায়িত্ব হল একই রকম কাজগুলো বাছাই করা।
ব্যাচ অপারেটিং সিস্টেমের সুবিধা:
- কোন কাজ শেষ হতে কত সময় লাগতে পারে, এটা অনুমান করা বেশ কষ্টসাধ্য। ব্যাচ অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রসেসর বুঝতে পারে কাজটি সমাধান হতে কত সময় লাগতে পারে।
- একাধিক কম্পিউটার ব্যবহারকারী ব্যাচ সিস্টেমের মাধ্যমে শেয়ার করতে পারে।
- ব্যাচ সিস্টেমের মাধ্যমে খুব কম সময়ে কাজ সমাধান করা যায়।
- ব্যাচ অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে বড় বড় কাজ খুব অল্প সময়ে করা সম্ভব।
ব্যাচ অপারেটিং সিস্টেমের উদাহরণ: আগের দিনের MS-DOS, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, কর্মচারীদের বেতনের হিসাব রাখা ইত্যাদি।
৫. ডিস্ট্রিবিউটেড ওএস
ডিস্ট্রিবিউটেড নামের মধ্যেই সংজ্ঞা লুকায়িত। এই ধরণের অপারেটিং সফটওয়্যারগুলো সাধারণত একই নেটওয়ার্কে যুক্ত অনেকগুলো কম্পিউটারের সাথে ভাগা ভাগি করে কাজ করে।
ডিস্ট্রিবিউটেড ওএস এর উদাহরণ: LOCUS
৬. নেটওয়ার্ক ওএস
এই ধরণের অপারেটিং সিস্টেমগুলো তৈরির মূল উদ্দেশ্য হল সফটওয়্যার, ফাইল সহ অন্যান্য জিনিসের শেয়ার ও অ্যাক্সেস ভাগ করে নেওয়া। এই যেমন ধরুন, আপনি গুগল ড্রাইভে আপনার প্রিয় ছবিটি আপলোড করে রেখেছেন। এখন এটা চাইলে আপনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে ইন্টারনেটের সাথে কানেক্ট হলে দেখতে পারছেন।
তো, এই ছবিটি যেখানে রাখা এটাই মূলত একটি সার্ভার কম্পিউটার। আর, এইগুলো পরিচালনার কাজ করে নেটওয়ার্ক অপারেটিং সিস্টেম।
নেটওয়ার্ক ওএসের উদাহরণ: BSD, Microsoft Windows Server 2008, UNIX
শেষ কথা
এই ছিল আজকে অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। আশা করি, অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে ও এর প্রকারভেদ নিয়ে কিছুটা হলেও সংশয় দূর করতে সক্ষম হয়েছি। আরেকটা বিষয়, অপারেটিং সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ প্রসেসর। তাই, প্রসেসর কি? প্রসেসর কিভাবে কাজ করে? জেনে রাখতে পারেন।
Nipa says
অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে সিরিয়াস একটা লেখা পড়লাম। কম্পিউটার ও মোবাইলসহ আরো কিছু অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে বিস্তারিত জানলাম।
জেসিকা জেসমিন says
ওমর ফারুক ভাই সবসময়ই সিরিয়াস লেখা লিখে থাকেন, তবে অনেক দিন ধরে উনার লেখা দেখছি না।
imran ali says
আমাদের যাদের কম্পিউটার বা স্মার্টফোন রয়েছে, তারা প্রত্যেকেই কোন না কোন অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করছি। কিন্তু এটি আসলে কি আর কিভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে হয়তো আমাদের সবার জানা নেই। সুতরাং, এটা জানানোর জন্যে হৈচৈ বাংলাকে ধন্যবাদ।
জেসিকা জেসমিন says
আপনাকেও ধন্যবাদ, ইমরান ভাই। এ ধরণের টেকনোলোজি রিলেটেড অনেক লেখা রয়েছে হৈচৈ বাংলায়।